মোঃ সোয়েব মেজবাহউদ্দিন
আমার মা লালমোহন মাধ্যমিক বালিকা বিদ্যালয়ের সিনিয়র শিক্ষিকা হিসাবে কর্মরত ছিলেন। প্রধান শিক্ষক সিদ্দিকুর রহমান আমার মায়ের কাছে তার বিরুদ্ধে সংবাদ প্রকাশ করার বিষয়ে অবহিত করে আমার নামে বিচার দিলেন। আমার মা আমার পড়াশুনা ছাড়া অন্য কিছু করা থেকে বিরত থাকার নির্দেশ দিলেন। দুই মাস পর আমার উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষা। তাই পড়াশুনার প্রতি মনোযোগ দিলাম।

১৯৯১ সালে লালমোহন শাহবাজুপর কলেজে আমার উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষা শুরু হলো। লালমোহন শাহবাজুপর কলেজের আমরা ৭৫ জন বিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থী ছিলাম। শাহবাজপুর কলেজের অধ্যক্ষ ছিলেন জনাব এ কে এম নজরুল ইসলাম। পরীক্ষার সময় ম্যাজিষ্ট্রেটের দায়িত্ব পালন করেছিলেন থানা সহকারী কমিশনার(ভূমি) কর্মকর্তা। লালমোহন বালিকা মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক সিদ্দিকুর রহমানের সাথে সহকারী কমিশনার (ভূমি) কর্মকর্তার ছিল বেশ সখ্যতা। আমার পরীক্ষার সময় সিদ্দিকুর রহমান থানা সহকারী কমিশনার(ভূমি) কর্মকর্তাকে দিয়ে আমার ক্ষতি করতে পারেন এই আশংকা আমার মা করেছিলেন। আমাকে শতর্ক থাকতে বললেন। আমি বিষয়টি কলেজের অধ্যক্ষ আমার নানা এ এক এম নজরুল ইসলামকে অবহিত করি। ৭৫ জন বিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থীর পরীক্ষার রুম ছিল আলাদা। প্রথম দিন সকালে বাংলা ১ম পত্র পরীক্ষা দিলাম। বিকালে বাংলা ২য় পত্র পরীক্ষা ছিল। বিকালে বাংলা ২য় পত্র পরীক্ষার সময় প্রধান শিক্ষক সিদ্দিকুর রহমান শাহবাজপুর কলেজে আসলেন। কিন্তু অজ্ঞাত কারনে কলেজের অধ্যক্ষ তাকে কোন পরীক্ষা কেন্দ্রে যেতে দেন নাই। অধ্যক্ষের রুম থেকে চা খেয়ে সিদ্দিকুর রহমান বিদায় হলেন। পরের দিন সকালে ইংরেজী ১ম পত্র এবং বিকালে ইংরেজী ২য় পত্র পরীক্ষা ভালভাবে শেষ হয়েছে।
৩য় দিন বিকালে শুধুমাত্র আমাদের বিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থীদের পদার্থ বিজ্ঞান ১ম পত্রের পরীক্ষা ছিল। মাত্র ৭৫ জন পরীক্ষার্থী ছিলাম। যথারীতি থানা সহকারী কমিশনার(ভূমি) কর্মকর্তা সাহেব কলেজে আসলেন, সাথে ছিলেন প্রধান শিক্ষক সিদ্দিকুর রহমান। আমি সিদ্দিকুর রহমানকে দেখেই ভয়ে পেয়ে গেলাম। অনুমান করতে পারলাম আমার কিছু একটা ক্ষতি আজ হবে। কলেজের অধ্যক্ষ স্যার তখন কলেজে ছিলেন না। মাত্র দুই ক্লাশরুমে পরীক্ষা হচ্ছিল। সিদ্দিকুর রহমান থানা সহকারী কমিশনার(ভূমি)কর্মকর্তার সাথে প্রথমে আমাদের কক্ষে ঢুকলেন এবং থানা সহকারী কমিশনার(ভূমি) কর্মকর্তাকে ইশারায় আমাকে দেখিয়ে দিলেন। থানা সহকারী কমিশনার(ভূমি)কর্মকর্তা আমার সামনে এসে আমার বললেন, কি খবর সাংবাদিক সাহেব, কেমন পরীক্ষা দিচ্ছেন ? থানা সহকারী কমিশনার(ভূমি) কর্মকর্তার এই প্রশ্ন শুনে ভয়ে আমার গলা শুকিয়ে গেল। আমি কোন উত্তর লিখতে পারছিলাম না। কিছুক্ষন দাঁড়িয়ে থেকে থানা সহকারী কমিশনার(ভূমি) কর্মকর্তা সিদ্দিকুর রহমানসহ কক্ষ থেকে বের হয়ে পাশের কক্ষে গেলেন। কিছুক্ষন পর থানা সহকারী কমিশনার(ভূমি) কর্মকর্তা আবার আমাদের রুমে আসলেন কিন্তু সিদ্দিকুর রহমান চলে গেলেন। থানা সহকারী কমিশনার(ভূমি) কর্মকর্তা হল পরিদর্শকের কাছ থেকে একটা চেয়ার নিয়ে আমাদের রুমে ২ ঘন্টা বসে থাকলেন।পরীক্ষা ছিল ২.৩০ মিনিটের। পরীক্ষা শেষ হবার ৩০ মিনিট আগে সহকারী কমিশনার(ভূমি) কর্মকর্তা চলে গেলেন। তিনি যাওয়ার পর আমাদের পদার্থ বিজ্ঞানের শিক্ষক শ্রদ্ধেয় নুরুল আমিন শাহজাহান স্যার ও বাহারুল ইসলাম কামাল স্যার আমাদের রুমে আসলেন। তারা দেখলের সবার উত্তর পত্র ফাঁকা। কেউ তেমন কিছুই লিখতে পারেনি। শাহজাহান স্যার সবাইকে পদার্থ বিজ্ঞানের ৪টা অংক মুখে বলে দিলেন। সবাই তা উত্তরপত্রে লিখলেন।এবং কয়েকটা প্রশ্নের উত্তর লেখার চেষ্টার করতেই পরীক্ষা শেষের ঘন্টা বেজে গেলো। আমার সহপাঠিরা মন খারাপ করে পরীক্ষা হল ত্যাগ করলেন। কেন বা কি কারণে আজ সহকারী কমিশনার(ভূমি) কর্মকর্তা আমাদের রুমে এভাবে বসে ছিলেন আমার সহপাঠি সিরাজউদৌলা নবাব ছাড়া আর কেউ বুঝতে পারেনি।
পরীক্ষা শেষ করে আমি বাসায় আসলাম। আমাকে দেখে আমার মা বুঝতে পারলেন আজকের পরীক্ষা ভাল হয়নি। বাসা থেকে বিকালে বাজারে বের হলাম। সহকারী কমিশনার(ভূমি) কর্মকর্তা ছিলেন ব্যাচলর। লালমোহন বালিকা বিদ্যালয়ের সামনে ছিল তার অফিস ও সরকারী কোয়াটার। সহকারী কমিশনার(ভূমি) কর্মকর্তার কোয়াটারের সামনে আসার পর দেখলাম প্রধান শিক্ষক সিদ্দিকুর রহমান সহকারী কমিশনার(ভূমি) কর্মকর্তার বাসা থেকে বের হচ্ছেন।আমি আড়ালে গিয়ে দাঁড়ালাম। সিদ্দিকুর রহমান বের হবার পর আমি সহকারী কমিশনার(ভূমি) কর্মকর্তার বাসায় গেলাম। কলিংবেল টিপতেই ট্রাউজার পড়ে তিনি বের হলেনে। আমাকে দেখে কিছুটা চমকে গেলেন। দরজার সামনে দাঁড় করিয়ে আমাকে জিজ্ঞাসা করলেন, কে তুমি, এই সময় আমার কাছে তুমি কি চাও? আমি বললাম, স্যার আমাকে কি চিনতে পেরেছেন? আজকের পরীক্ষার সময় যে সাংবাদিকের সাথে কথা বলেছিলেন আমি সেই সাংবাদিক, স্যার, আপনার সাথে আমার কোন শত্রুতা নেই, তারপরও আজ আপনার জন্য আমার পরীক্ষা খারাপ হয়েছে। স্যার আমি বিজ্ঞান বিষয়ের ছাত্র। নিউটনের একটা সুত্র আছে, ”প্রত্যেক ক্রিয়ার সমান ও বিপরীত প্রতিক্রিয়া আছে।” আজ আপনি আমাদের যে ক্ষতি করলেন তার জন্য আপনাদের একদিন অনুতপ্ত হতে হবে। আমার কথা শুনে সহকারী কমিশনার(ভূমি) কর্মকর্তা আমার দিকে তাকিয়ে কিছুক্ষন তাকিয়ে রইলেন, তারপর বললেন ভেতরে আসো।আমার মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন, আমি দুঃখিত, যাও বাসায় যাও। দোয়া করি আগামীকাল থেকে ভালভাবে পরীক্ষা দিও। পরের পরীক্ষার সময় সহকারী কমিশনার(ভূমি) কর্মকর্তা একবার শুধু পরীক্ষা কেন্দ্রে এসে আমাকে দেখে একটা মুচকি হেসে হল থেকে বের হয়ে চলে গেলেন। চলবে-