অধ্যাপক (ডা.) এম এ সামাদ, কিডনি রোগ ও মেডিসিন বিশেষজ্ঞ
কিছু তথ্য জানার পর আপনারা বুঝতে পারবেন কিডনি সম্পর্কে সচেতন হওয়া কেন এত জরুরী, কেনই বা বিশ্ব কিডনি দিবস ২০২২ এর প্রতিপাদ্য বিষয় – করফহবু ঐবধষঃয ভড়ৎ অষষ-ইৎরফমব ঃযব শহড়ষিবফমব মধঢ় ঃড় নবঃঃবৎ শরফহবু পধৎব. অর্থাৎ কিডনি স্বাস্থ্য উন্নয়নে জ্ঞানের বিকল্প নেই। আপনি দেশের সাধারণ নাগরিক হোন বা চিকিৎসা পেশা ও স্বাস্থ্য সেবার সাথে জড়িত থাকুন অথবা দেশের নীতিনির্ধারক হোন, আপনাকে কিডনি সম্পর্কে জানতে হবে।
দুই যুগ আগে মৃত্যুর কারণ হিসেবে কিডনি রোগ ছিল ২৭ তম অবস্থানে, বর্তমানে তা উন্নীত হয়েছে ৭ম স্থানে, এরপর ২০৪০ সালে দখল করবে ৫ম স্থান। মৃত্যুর কারণ হিসেবে কিডনি রোগ সামনে আসার জন্য ‘উসাইন বোল্ট’ এর সাথে পাল্লা দিয়ে এগুচ্ছে।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার রিপোর্ট অনুসারে, ২০৪০ সালের মধ্যে ৫০ লাখের বেশি কিডনি বিকল রোগী সংকটাপন্ন অবস্থায় চিকিৎসার অভাবে অকাল মৃত্যুবরণ করবে। বর্তমানে ৮৫ কোটির অধিক লোক কিডনি রোগে আক্রান্ত। দুঃখজনক হলেও সত্য, এর মধ্যে ৭৫ কোটি রোগী জানেনা যে মরণঘাতী কিডনি রোগ নীরবে তাদের কিডনি নষ্ট করে চলেছে। প্রতি বছর ১ কোটি ৩০ লাখ লোক আকস্মিক কিডনি বিকল রোগে আক্রান্ত হয় যার ৮৫ ভাগই আমাদের মতো উন্নয়নশীল দেশে। উন্নত দেশে কিডনি বিকলের চিকিৎসা করতে গিয়ে সরকার হিমশিম খাচ্ছে। ২০১৯ সালে আমেরিকার শুধু ডায়ালাইসিস ও কিডনি সংযোজন ব্যয় হয়েছে ৫৭ বিলিয়ন ডলার যা প্রায় আমাদের জাতীয় বাজেটের সমান।
বিভিন্ন পরিসংখ্যান থেকে ধারণা করা হয়, বাংলাদেশে ২ কোটির অধিক লোক কিডনি রোগে আক্রান্ত। কিডনি রোগের শেষ পরিণতি কিডনি বিকল। একবার কিডনি বিকল হয়ে গেলে বেঁচে থাকার একমাত্র উপায় কিডনি সংযোজন অথবা ডায়ালাইসিস কিন্তু এই চিকিৎসা এতটাই ব্যয়বহুল যে, শতকরা ১০ জন কিডনি বিকল রোগী এর চিকিৎসা ব্যয় বহন করতে পারে না। তাই আমাদের মত উন্নয়নশীল দেশ, যেমন – বাংলাদেশ, ভারত, পাকিস্তান, নেপাল এর প্রায় শতকরা ৯০ভাগ রোগী বিনা চিকিৎসায় অথবা আংশিক চিকিৎসায় মৃত্যুবরণ করে। পক্ষান্তরে সবাই যদি কিডনি রোগের ব্যাপকতা, ভয়াবহতা, পরিণতি ও কারণ সম্পর্কে সচেতন থাকে এবং স্বাস্থ্যসম্মত জীবনযাপন করে তা হলে ৬০ভাগ ক্ষেত্রে এই মরণঘাতী কিডনি বিকল প্রতিরোধ করা সম্ভব। যেখানে ১০ ভাগের চিকিৎসা দিতে দেশ হিমশিম খাচ্ছে, পরিবার নিঃস্ব হয়ে যাচ্ছে, সেখানে ৬০ভাগ প্রতিরোধ কি একটি বড় অর্জন নয়?।
কিডনি কেন এত গুরুত্বপূর্ণ ?
আমাদের দেহ হাজারো জটিল মেশিনের সমাহার। এগুলোতে প্রতিনিয়ত ক্রিয়া-বিক্রিয়া চলছে। এর ফলে অনেক ধরনের বিষাক্ত রাসায়নিক পদার্থ তৈরী হয়। কিডনি প্র¯্রাবের মাধ্যমে এসব বিষাক্ত পদার্থ বের করে দিয়ে রক্ত পরিশোধন করে। কিডনি রক্তের লোহিত রক্ত কণিকা তৈরী করতে সাহায্য করে, হাড় মজবুত রাখে, রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণ করে, শরীরে পানির সমতা রক্ষা করে। আমাদের কিডনিকে বলা হয় মহারসায়নবিদ। আমাদের শরীরে অনেক ধরনের রাসায়নিক উপাদান যেমন-সোডিয়াম, পটাশিয়াম, ক্যালসিয়াম, লোহা, পিতল, দস্তা ইত্যাদি নির্দিষ্ট মাত্রায় থাকে। তাদের যে কোন একটির ভারসাম্য নষ্ট হলে আমাদের মৃত্যু হতে পারে। অতি নিখুঁতভাবে এসব উপাদানের ভারসাম্য রক্ষা করে কিডনি। তাই কিডনি আমাদের বেঁচে থাকার জন্য অত্যন্ত জরুরী এক বিস্ময়কর অঙ্গ।
কিডনি বিকল কি ?
যে কোন কারণে যদি কিডনির কার্যক্ষমতা কমে যায় বা নষ্ট হয়ে যায় তাকে বলা হয় কিডনি বিকল।
আকস্মিক কিডনি বিকল বা অপঁঃব করফহবু ওহলঁৎু (অকও)
যদি হঠাৎ করে ভালো কিডনি, কোন কারণে দ্রæত, কয়েক ঘন্টা থেকে কয়েক দিনের মধ্যে কর্মক্ষমতা হারিয়ে ফেলে, তাকে বলে আকস্মিক কিডনি বিকল (অপঁঃব করফহবু ওহলঁৎু). যেমন- ডায়রিয়া, বমি, রক্তক্ষরণ, তীব্র প্রদাহ, বেদনানাশক ঔষধ, ভেজাল খাদ্য, অথবা প্র¯্রাব প্রবাহে বাধার কারণে আকস্মিক কিডনি বিকল হতে পারে। এই ক্ষেত্রে প্রাথমিক অবস্থায় শনাক্ত করে চিকিৎসা করলে কিডনি সম্পূর্ণ ভালো হয়ে যায়।
দীর্ঘস্থায়ী কিডনি রোগ বা ঈযৎড়হরপ করফহবু উরংবধংব (ঈকউ) ঃ
যখন কিডনি ধীরে ধীরে, মাসের পর মাস, বছরের পর বছর ধরে কিডনি ছাঁকনিগুলো নষ্ট হতে থাকে, তখন তাকে দীর্ঘস্থায়ী কিডনি রোগ বা ক্রনিক কিডনি ডিজিজ (ঈযৎড়হরপ করফহবু উরংবধংব) বলা হয়। ক্ষয়ের পরিমাণের উপর নির্ভর করে ঈকউ (সি.কে.ডি) কে পাঁচটি ধাপে ভাগ করা হয়; প্রথম ধাপ হলো আক্রমণ শুরু অন্যদিকে পঞ্চম ধাপ হলো যখন কিডনির ক্ষমতা ১৫ ভাগের নিচে নেমে আসে। এক থেকে চতুর্থ নম্বর ধাপের মধ্যে যদি রোগ ধরা পড়ে তবে চিকিৎসা, খাদ্যাভ্যাস ও সুস্থ জীবন ধারা চর্চার মাধ্যমে কিডনি দীর্ঘদিন ভালো রাখা যায়, রোগ সংক্রান্ত জটিলতা ঠেকিয়ে রাখা যায়।
ঈকউ বা দীর্ঘস্থায়ী কিডনি রোগের শেষ পরিণতি কি ?
প্রাথমিক অবস্থায় চিকিৎসা না পেলে কিডনি সম্পূর্ণ নষ্ট হয়ে যেতে পারে, তখন যদি ডায়ালাইসিস অথবা কিডনি সংযোজন না করা হয়, তা হলে মৃত্যু অবধারিত। তবে ঈকউ এর আতঙ্কিত করার দিক হল এ রোগ অন্য জীবন সংহারী রোগের হার অনেক গুনে বাড়িয়ে দেয়। যেমন সামান্য মাত্রায়ও যদি ঈকউ থাকে তবে হৃদরোগের হার সাধারণ মানুষের চেয়ে দশ থেকে শতগুণ বাড়িয়ে দিতে পারে, তেমনি ব্র্রেইন স্ট্রোক এর হারও বেড়ে যায়। সেই জন্য কিডনি রোগকে বলা হয় ডিজিজ-মালটিপ্লায়ার।
কিভাবে আমরা দীর্ঘস্থায়ী কিডনি রোগের শিকার হই ?
ভালোভাবে লক্ষ্য করলে দেখা যাবে সি.কে.ডি এর মূল কারণগুলো আমাদের জীবনধারা চর্চা বা লাইফ স্টাইল এর সাথে লতা-পাতার মতো জড়িয়ে আছে যার নিয়ন্ত্রণ ক্ষমতা নিজের হাতেই। সি.কে.ডি অনেক কারণে হতে পারে। তবে প্রধান কারণ হলো- অনিয়ন্ত্রিত ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ, স্থ‚লতা, ধূমপান, অলস জীবন যাপন, অস্বাস্থ্যকর খাবার গ্রহণ প্রভৃতি।
অন্যদিকে কিডনি সম্পর্কে সামান্য কিছু জ্ঞানের অভাবে কিডনি বিনষ্ট হয়। যেমন- মোয়া-মুড়ির মতো ব্যাথার ঔষধ খাওয়া, ভেজাল খাদ্য গ্রহণ, বাচ্চাদের গলা ব্যথা, খোসপাঁচড়া চিকিৎসায় অবহেলা, জন্মগত কিডনি সমস্যার দিকে মা-বাবা সচেতন না থাকা, অনেক সময় দেখা যায় বাচ্চাদের সামান্য জন্মগত ত্রুটির কারণে পরবর্তী সময় কিডনি বিকল হয়ে যায় অথচ খুব সহজেই বাচ্চাদের এসব ত্রুটি প্রাথমিক অবস্থায় শনাক্ত হলে তা চিকিৎসাযোগ্য।
তাছাড়া কিডনি বিকলের আরো কারণ আছে; যেমন- বংশগত, কিডনিতে পাথর, মূত্রতন্ত্রের সংক্রমণ, প্র¯্রাব প্রবাহে বাধা জনিত রোগ, বয়স জনিত কিডনি রোগ। নিয়মিত কিডনি পরীক্ষা করে প্রাথমিক অবস্থায় যদি কিডনির যেকোনো রোগ শনাক্ত করা যায়, তবে কিডনি বিকল আটকে দেয়া যায়। শুধু রক্তের ক্রিয়েটিনিন থেকে ইজিএফআর নির্ণয় করে এবং প্র¯্রাব পরীক্ষা করেই প্রাথমিক অবস্থায় এই রোগ শনাক্ত করা যেতে পারে। মনে রাখবেন কিডনির ক্ষমতা ৮০ থেকে ৯০ ভাগ বিনষ্ট হওয়ার পূর্বে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে কোনো লক্ষণ দেখা যায় না। তাই যারা কিডনি রোগের ঝুঁকিতে আছেন তারা বছরে অন্তত একবার রক্ত ও প্র¯্রাব পরীক্ষা করে কিডনির অবস্থা জেনে নিবেন।
কিডনি রোগের প্রাদূর্ভাব ব্যাপক, পরিনতি ভয়াবহ কিন্তু আমরা যদি নি¤েœ বর্ণিত সুস্থ জীবনধারা চর্চা করি তবে ৫০ থেকে ৬০ ভাগ ক্ষেত্রে মরণঘাতী কিডনি বিকল প্রতিরোধ করা সম্ভব।
কিডনি ভাল রাখার উপায় ঃ
০১) কায়িক পরিশ্রম, খেলাধূলা ও নিয়মিত ব্যায়াম করা।
০২) উচ্চ রক্তচাপ এবং ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে রাখা।
০৩) সুপ্ত উচ্চ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণের জন্য নিয়মিত রক্তচাপ পরীক্ষা করা।
০৪) স্বাস্থ্যসম্মত খাবার গ্রহণ যাতে প্রতিদিন শাক-সবজি ও ফল থাকে এবং ওজন নিয়ন্ত্রণে রাখা।
০৫) পর্যাপ্ত পরিমাণে পানি পান করা।
০৬) ধূমপান থেকে বিরত থাকা।
০৭) ডাক্তারের পরামর্শ ছাড়া কোন ঔষধ সেবন না করা।
০৮) অন্যান্য রোগের চিকিৎসায় অবহেলা পরিহার।
০৯) সুশৃংখল জীবন যাপন।
১০) নিয়মিত কিডনির কার্যকারীতা পরীক্ষা করা।
সবার জন্য কিডনি স্বাস্থ্য কি ভাবে নিশ্চিত করা যায় ?
কিডনি রোগ প্রতিরোধের জন্য স্বাস্থ্য সচেতন থাকতে হবে, সুস্থ জীবন ধারা চর্চা করতে হবে। তবে চিন্তার বিষয় যাদের কিডনি নষ্ট হয়ে গেছে, যাদের বেঁচে থাকার জন্য ডায়ালাইসিস অথবা কিডনি সংযোজনের বিকল্প নাই কিন্তু ব্যয়বহুল বিধায় আমাদের দেশের শতকরা ৯০ ভাগ রোগী আংশিক অথবা বিনা চিকিৎসায় অকাল মৃত্যুবরণ করে। খাদ্য, বস্ত্র, আশ্রয় যেমন মানুষের মৌলিক অধিকার, তেমনি বেঁচে থাকাও মানুষের জন্মগত অধিকার। তাই অকাল মৃত্যু ঠেকাতে সকল কিডনি বিকল রোগীদের স্বাস্থ্য বীমার আওতায় আনতে হবে। এ জন্য প্রয়োজন স্বাস্থ্য বীমা। ইউনিভার্সাল হেলথ কভারেজ এর আওতায় ‘‘কিডনি সুরক্ষা বীমা’’ চালু করলে সবার জন্য কিডনি স্বাস্থ্য নিশ্চিত হতে পারে।
লেখকঃ অধ্যাপক (ডা.) এম এ সামাদ
কিডনি রোগ ও মেডিসিন বিশেষজ্ঞ
সভাপতি, কিডনি এওয়ারনেস মনিটরিং এন্ড প্রিভেনশন সোসাইটি (ক্যাম্পস)
অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান, নেফ্রোলজি বিভাগ
আনোয়ার খান মডার্ণ মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল