Monday, May 12, 2025
Homeবাংলাদেশস্মরণঃ রশিদ হায়দার

স্মরণঃ রশিদ হায়দার

সালমা চৌধুরী (জলি)

১৪ই অক্টোবর ২০২০, “দি ডেইলি স্টার” পত্রিকার মাধ্যমে জানতে পারি শ্রদ্ধেয় রশিদ হায়দার ভাই পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করে না ফেরার দেশে চলে গেছেন। সংবাদটি দেখে আমি অনেকক্ষণের জন্য স্তদ্ধ হয়ে থাকলাম। গত ৩৩ বছর ধরে আমি ব্যক্তিগতভাবে উনাকে একজন সাহিত্যিক ও সাংবাদিক হিসাবে চিনি। গভীরভাবে বলতে গেলে বলতে হয়, যখনই আমি আমার বাবা , শহীদ ইঞ্জিনিয়ার শামসুজ্জামানকে স্মরণ করি তখনই আমার শ্রদ্ধেয় রশিদ ভাইয়ের কথা মনে হয়। কারণটা হয়ত অনেকের জানা নেই।

সালমা চৌধুরী

আমার বাবা ছিলেন পূর্ব পাকিস্তানের চট্রগ্রাম পোর্ট ট্রাষ্ট (CPT) এর চীফ ইঞ্জিনিয়ার ও চট্রগ্রাম ইঞ্জিনিয়ার ইনস্টিটিউট এর চেয়ারম্যান। ২৩শে মার্চ, ১৯৭১ সালে করাচি থেকে জাহাজের মাধ্যমে অস্ত্র ও গোলাবারুদ চট্টগ্রামে এসেছিল, তিনি তখন সেই অস্ত্র ও গোলাবারুদ গুলো খালাস না করার জন্য বন্দরের কর্মীদের উদ্বুদ্ধ করেন। আমার মতে এই উদ্যোগ মুক্তিযুদ্ধ আরম্ভ হওয়ার প্রথম মুখোমুখি সংঘর্ষ। এছাড়াও আমার বাবা কালুরঘাট রেডিও স্টেশন খোলার জন্য রেডিও ইঞ্জিনিয়ারদেরকে উৎসাহিত করেন, যাতে করে ঐ কেন্দ্র থেকে স্বাধীনতার ঘোষনা দেওয়া যায় এবং সারাবিশ্বে আমাদের স্বাধীনতা যুদ্ধের কথা জানানো যায়। চট্টগ্রামে তিনি যে মুক্তিযুদ্ধের একজন সংগঠক হিসাবে ভূমিকা রেখেছিলেন এই ইতিহাস তৎকালীন রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দেদের জানা ছিল। ২১শে মে, ১৯৭১ সালে পাকিস্তান নৌবাহিনী থেকে আমার বাবাকে হানাদার বাহিনী তুলে নিয়ে যায়, আমাদের মাঝে আর উনি ফেরেননি। ১৯৮৭ সাল, মাস টা মনে নেই  একদিন সকালে হঠাৎ আমি একটি ফোন রিসিভ করি। যেখানে এক ভদ্রলোক বিনীত ও নরমস্বরে বলেন আমি রশিদ হায়দার, ডেপুটি ডিরেক্টর, বাংলা একাডেমী। তিনি বলেন আমি শহীদ মুক্তিযোদ্ধাদের স্মৃতিগুলো সংকলন করতে চাই। এজন্য শহীদ মুক্তিযোদ্ধদের পরিবারের মধ্য থেকে নির্দিষ্ট কিছু বুদ্ধিজীবিদের স্মৃতি চিহ্ন, শহীদদের দুঃখ-যন্ত্রণা ও তাদের আত্নবলির উপরে লেখা সংগ্রহ করছি। তাই আপনার বাবা শহীদ ইঞ্জিনিয়ার শামসুজ্জামানের স্মৃতি সর্ম্পকে কিছু জানতে চাই। আমার ঐ সময়কার অনুভূতির কথা আমি ভাষায় প্রকাশ করতে পারবোনা। মনে হচ্ছিল যাদের মহান আত্নত্যাগে আমাদের দেশ স্বাধীন হয়েছে, যাদের জন্য আমরা এই স্বাধীন মাতৃভূমি পেয়েছি,আমার বাবা তাদেরই মধ্যে একজন। এই সকল মহান মুক্তি যোদ্ধাদের স্মৃতিচারণে আমিও অংশ গ্রহণ করতে পারছি, এই অনুভূতি আমার জন্য যতটা গৌরবের, ভালবাসার সাথে সাথে ততটা বিষাদেরও।১৯৭১ থেকে ১৯৮৭ সাল, দীর্ঘ ১৬ বছর আমি আমার বাবাকে দেখিনি। আমি শ্রদ্ধেয় রশিদ ভাইয়ের কথায় আমার বাবার স্মৃতিচারণ করতে সম্মত হলাম। পরের দিন রশিদ ভাই আমার বাসায় আসলেন। সুতির পায়জামা-পাঞ্জাবী পরা, ও কাঁধে একটা কাপড়ের ঝোলা নিয়ে এসেছেন একজন সৌম্য চেহারার মানুষ। দেখেই ভক্তি হল। প্রায় ঘন্টাখানেক সময় নিয়ে তিনি আমাকে উনার প্রজেক্ট সমন্ধে বিস্তারিত বললেন। যখন আমি বললাম, “আমিতো লেখক নই”, তখন তিনি আমাকে সাহস দিলেন এবং বললেন প্রয়োজনে লেখায় আমাকে সাহায্য করবেন। সেই সময় আমি রশীদ ভাইয়ের সাথে বেশ কয়েকবার সাক্ষাৎ করেছি। নম্র, ভদ্র, নিরহংকার ও বিশেষ অমায়িক এই ভদ্রলোকের সাক্ষাৎ পেয়ে আমি ধন্য হলাম।
“স্মৃতি একাত্তর” প্রকাশিত হয় ১৯৮৮ সালে। তিনি আমাকে বাসায় এসে এই বইয়ের ১ টি কপি উপহার স্বরূপ দেন এবং দেখালেন “আমার বাবা” লেখাটি বইয়ের প্রথম রচনা হিসাবে জায়গা পেয়েছে। এই সম্মান পাওয়া আমার জন্য কত আনন্দের ছিল বোঝাতে পারবোনা। শ্রদ্ধেয় রশীদ ভাইয়ের প্রতি আমার অপার কৃতঞ্জতা জ্ঞাপন করছি।
দীর্ঘ এই কয় বছর রশিদ ভাইয়ের সাথে আমার অনেকবার সাক্ষাৎ হয়েছে, প্রতিবারই তিনি আমাকে সাদর সম্ভাষণে সম্মানিত করেছেন। এমনকি অন্যদের সাথে আমাকে “সালমা আপা” হিসাবে পরিচয়ও করিয়ে দিতেন। এটা আমার জন্য অনেক সম্মানের।শ্রদ্ধেয় রশিদ ভাইয়ের পৃথিবী থেকে চলে যাওযার সংবাদ আমার কাছে অনেক কষ্টের, অনেক বেদনার। দোয়া চাচ্ছি মহান আল্লাহ্তায়ালা উনাকে “জান্নাতুল ফেরদৌস” দান করুক এবং তার পরিবার যেন এই মহান ব্যক্তির শোক কাটিয়ে উঠার তওফিক লাভ করেন।

সালমা চৌধুরী (জলি), ফাউন্ডার চেয়ারপার্সন, আশিক, ফাউন্ডেশন ফর চাইল্ডহুড ক্যান্সার, ঢাকা বাংলাদেশ।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

- Advertisment -

সর্বাধিক জনপ্রিয়

সাম্প্রতিক মন্তব্য