মীর নাজিম উদ্দিন আহমেদ, সিইও
১১-১২ বছরের ছোট এক কিশোর ধানমন্ডি গভঃ বয়েজ হাই স্কুলের ৭ম শ্রেনীতে পড়া অবস্থায় বড় ভাইয়ের সহযোগীতায় ১৯৭১ সালের ৭ই মার্চ খদ্দরের লাল মুজিব কোর্ট পরে রেসকোর্স ময়দানে আকাশ সমান যার উচ্চতা সেই বঙ্গবন্ধুর বক্তৃতা শুনতে গিয়ে অনেকের দৃষ্টি আকর্ষণ করা ছেলেটি বাঁশের লাঠি ট্রেনিং, মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য খবরাখবর সংগ্রহ করতে করতে ১৬ই ডিসেম্বরের বিজয় দিবসের ক্ষমতা হস্তান্তর অনুষ্ঠানে উপস্থিত থেকে নিজেকে বিজয়ের নায়ক মনে করে। যুদ্ধ পরবর্তীতে ১০ই জানুয়ারী ১৯৭২ বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তন দিবসে উপস্থিত হতে পেরে নিজেকে ধন্য মনে করেছে। পরবর্তীতে ১৯৭৫ সালের ১৫ই আগস্ট বঙ্গবন্ধুর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে জুলিও কুড়ি পুরষ্কার নেবার কথা আর আমার জীবনের সর্বশ্রেষ্ঠ পরীক্ষা অর্থাৎ এস.এস.সি পরীক্ষার ফল প্রকাশের দিন। সেদিন বঙ্গবন্ধুর নির্র্মম শাহাদাৎ বরণ আমার কিশোর মনে গভীর ক্ষতের সৃষ্টি করে।
ছোট বেলা থেকেই সে মহীরূহ সমান মানুষটির প্রতি শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা আমার রক্ত কনিকায় প্রতি নিয়ত অনুরনীত হতে থাকে। দেশের জন্য কিছু করার তাগিদ অনুভব করি। বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বোচ্চ ডিগ্রী অর্জনের পর কালের পরিক্রমায় বঙ্গবন্ধুর আদর্শের প্রতীক হয়ে ১৯৮৬ সাল থেকে বীমা শিল্পের সাথে জড়িত হই। দীর্ঘ ২৮ বছর এই সেক্টরের সকল শাখায় কাজের মাধ্যমে অভিজ্ঞতা অর্জন করে ২০১৩ সাল থেকে ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও সিইও হিসাবে কর্মরত থেকে নন-লাইফ বীমার বিভিন্ন সমস্যা নিয়ে প্রায় ৭ বৎসর যাবৎ লেখে চলেছি। যদি আমার লেখনি এই শিল্পের জন্য সামান্যতম ইতিবাচক অবস্থান তৈরী করতে পারে সেটাই বঙ্গবন্ধুর একজন কর্মী হিসাবে আমার স্বার্থকতা।
বীমা একটি সার্বজনীন বিষয়। ব্যক্তি এবং সম্পদের নিরাপত্তার জন্যই বীমার জন্ম। তাই বীমাকে অবহেলা করার সুযোগ নেই। মানব জাতির জীবন এবং তাঁর সারাজীবনের সঞ্চিত অর্থ ও সম্পদের নিরাপত্তা বিধান করাই বীমার কাজ। অগ্নিকান্ডে রাজধানী শহর ঢাকার নিমতলী, বনানীর এফ.আর. টাওয়ার, ষ্টান্ডার্ড গ্রুপের বা তাজরিন এপারেলস ইত্যাদির অগ্নি দুর্ঘটনার কথা কি আমরা ভুলে যেতে পারি? সেখানে সম্পদের পাশাপাশি কতশত লোক আহত ও নিহত হয়েছেন। আর কত আর্থিক ক্ষতি হয়েছে তা আজো আমাদের অজানা। ছোট একটি দূর্ঘটনা যে কোন একটি বীমা কোম্পানীকে পঙ্গু করে দিতে যথেষ্ট। সে দিকে দৃষ্টি রেখেই স্বচ্ছতা ও দক্ষতার সাথে অনৈতিক কাজ থেকে দূরে থেকে বীমা ব্যবসা চালিয়ে যেতে হবে।
আমাদের মধ্যে নীতি-নৈতিকতা ও সচেতনতার অভাব রয়েছে। বঙ্গবন্ধু তাঁর প্রজ্ঞা ও রাজনৈতিক ধ্যান ধারনার বাস্তবায়নে বীমা শিল্পকে বেঁছে নিয়েছিলেন আর সেখান থেকেই একটি স্বাধীন দেশের জন্ম দিয়েছিলেন। তাই স্বাধীনতার পর এই বীমা শিল্পকে ঢেলে সাজানোর জন্য কতই না চেষ্টা করেছেন কিন্তু কিছু অতি লোভী এবং দুষ্ট প্রকৃতির ব্যক্তিরা বার বার তাতে বাঁধার সৃষ্টি করেছেন। পাট ও তূলার গুদামে আগুন লাগিয়ে বীমা ব্যবসাকে অস্থির করে তুলে এবং দেশের অর্থনীতির গতিকে রুদ্ধ করার চেষ্টা করে।
পরবর্তীতে এরশাদ সাহেবের হাত ধরে আশির দশকে বেসরকারী খাতে বীমা শিল্পের গোড়াপত্তন ঘটে। রাজনৈতিক ইচ্ছায় বীমা শিল্পের সংখ্যা বাড়তে বাড়তে বর্তমানে নন-লাইফ বীমার সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৪৬টি যা আমাদের দেশের অর্থনীতির পরিসরে এদের সুন্দরভাবে টিকে থাকা অত্যন্ত দুষ্কর। আর তাই অস্তিত্বের লাড়াইয়ে টিকে থাকতে অনেকেই নীতি নৈতিকতার কথা ভুলে যান। যারা রাজনীতির বড় পৃষ্ঠপোষক তাদের কোম্পানীর দ্বারাই বীমা শিল্প বর্তমান বাজারে অস্থিরতার সৃষ্টি করছে। তাঁরা এসোসিয়েশনের সাথে তৎপ্রোতভাবে জড়িত থেকে নিজেদের লাভের আশায় শিল্পকে কলুষিত করছেন। এই কাজে কিছু সংখ্যক সিইও জড়িত রয়েছেন। গুটি কয়েক কোম্পানীর জন্য বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষের বীমা শিল্পের পরিচ্ছন্নতার জন্য ইস্যুকৃত ৬৪, ৭৫ এবং ৮৪ নং সার্কুলার বাস্তাবয়নে বাঁধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। সার্কুলার নং-৮৪ এর ৩নং ধারায় উন্নয়ন কর্মকর্তা, চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ এদের জন্য পারিশ্রমিকের কোন হার নির্ধারণ করে দেয়া হয়নি। পারিশ্রমিকের হার নির্ধারিত না থাকার কারণে কিছু লোভী ও দুষ্ট লোক মার্কেটে নতুন করে অস্থিরতা শুরু করেছে। এই অস্থিরতা রোধে বিআইএ এবং আইডিআরএ-কে সম্মিলিতভাবে পারিশ্রমিকের একটি হার অবশ্যি নির্ধারণ করে দিতে হবে।
বাংলাদেশ ইন্স্যুরেন্স এসোসিয়েশন এর মহৎ উদ্যোগ যার ব্যবসা সে করবে। এই ব্যাপারে বার বার বিভিন্ন পদক্ষেপ নিলেও তা কয়েকটি কোম্পানীর জন্য বাস্তবায়িত হচ্ছে না। অভিযোগ শুনানী কমিটি আবারো ০৩-০৬-২০২১ইং তারিখে ভার্চুয়াল সভার আয়োজন করেছেন, দেখা যাক অবস্থার উন্নতি হয় কিনা? সিদ্ধান্তের সঠিক বাস্তবায়ন না হওয়ায় ছোট কোম্পানীগুলো তাদের ব্যবসা হারিয়েছে আবার আবেদন নিবেদন করেও ক্ষেত্রভেদে কোন প্রতিকার না পাওয়ার কারণে অনেক বীমা কোম্পানীর শিক্ষিত ও প্রশিক্ষিত দীর্ঘদিনের অভিজ্ঞ মূখ্য নির্বাহী কর্মকর্তাদের অনেকে চাকুরী হারিয়ে আজ পথে পথে ঘুরে বেড়াচ্ছেন। অথচ অযোগ্যরা সময় বাড়িয়ে বাড়িয়ে ঠিকই কোম্পানীতে বহাল তবিয়তে আছেন। অযোগ্যদের পরিবর্তে যোগ্য লোককেই কোম্পানীর সিইও হিসাবে কাজ করার সুযোগ সৃষ্টি বিআইএ ও আইডিআরএ-কে করে দিতে হবে।
বীমা শিল্পে শৃংখলা বজায় রাখতে হলে বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষকে শিল্পের স্বার্থে এবং কারোর কথায় প্ররোচিত না হয়ে প্রাথমিকভাবে সকল নন-লাইফ বীমা কোম্পানীগুলো হিসাব বিজ্ঞান ও বীমা জ্ঞান সম্পন্ন জন বল দিয়ে বা চার্টার্ড একাউন্ট্যান্ট ফার্ম দিয়ে অডিট করিয়ে কোন কোম্পানীর কি সমস্যা আছে তা চিহ্নিত করে বাস্তবমুখী সমাধানের পথ খুঁজে বের করতে হবে।
একটি বাস্তব অভিজ্ঞতার কথা না বললেই নয়ঃ আমি গত ৩০শে মে, ২০২১ তারিখে আমার কোম্পানীর এক পরিচালকের পরামর্শে তাঁর পরিচিত এক গ্রুপ অব কোম্পানী ভিজিট করি। আলোচনান্তে জানতে পারি সে গ্রুপে ১ম প্রজন্মের ৩টি, ২য় প্রজন্মের ১টি এবং ৩য় প্রজন্মের ১টি কোম্পানীসহ মোট ৫টি বীমা কোম্পানী সেখানে বীমা ব্যবসা করে। তাদের কমিশন হিসাবে অর্ধশত % প্রিমিয়ামের টাকা ফেরৎ দেয়া হয় এবং কোন ক্ষতি হলে বীমা কভার না থাকলেও বীমা কোম্পানী কাগজপত্র তৈরী করে অনৈতিকভাবে তাদের প্রাপ্যের চেয়েও অনেক বেশী টাকার দাবী পরিশোধ করে থাকে। এই কথা শুনার পর লজ্জায় আমার মাথা হেট হয়ে যায়। ঐ কোম্পানীর ব্যবস্থাপনা পরিচালক মহোদয় অত্যন্ত সমীহের সাথে আমাকে মৃদু হেসে বললেন আপনি কি করতে পারবেন? আমি অবাক হয়ে বললাম আমার পরিচালক মহোদয়ের সাথে কথা বলে আপনাদেরকে পরে জানাবো। ১ম প্রজন্মের যে সকল বীমা কোম্পানীগুলো নিয়ে আমরা গর্ববোধ করি তারা যদি এই ধরণের অনৈতিক কাজ করে বীমা পেশাকে কলুষিত করে তবে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য এই পেশা কতটুকু ভালো হবে এবং কেনই বা তারা বীমা পেশায় আসবে তা আমাদের ভেবে দেখার সময় এসেছে।
বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান মহোদয় বীমা শিল্পের লোক এবং একজন চার্টার্ড একাউন্ট্যান্ট। তাঁকে সহযোগীতা করার জন্য উপযুক্ত মেম্বারদয় ও পরিচালক ও নির্বাহীরা রয়েছেন। তা ছাড়া এসোসিয়েশনের প্রেসিডেন্ট সাহেব নিজেই বলেছেন আমার কোম্পানী অন্যায় করলে তা সামনে নিয়ে আসুন। আমাদের অর্থমন্ত্রী মহোদয় একজন চাটার্ড একাউন্ট্যান্ট এবং বীমা শিল্পের লোক। তিনিও স্বচ্ছতা ও জবাবদিহীতা চান। এত কিছুর পরেও বীমা শিল্প ভালো হতে বাঁধা কোথায় তা ভাবার বিষয়। তাই সত্ত্বর সকল বীমা কোম্পানীগুলো অভিজ্ঞ ও দক্ষ লোকবলের মাধ্যমে অডিট করিয়ে নিম্নলিখিত বিষয়গুলোর রহস্য কি তা খতিয়ে দেখতে হবেঃ
১। বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষের ইস্যুকৃত ৬৪ নং সার্কুলার জারির পরও নির্ধারিত হিসাবের বাইরে অতিরিক্ত হিসাব পরিচালনার মাধ্যমে কোন কোন কোম্পানী কিভাবে ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছে।
২। ৮৪নং সার্কুলারের পরেও মার্কেটে কি প্রক্রিয়ায় শুন্য কমিশন এখনও অর্ধশত পার্সেন্টেজে কাজ চলছে।
৩। কারা অস্বচ্ছ দাবীর মাধ্যমে বীমা কোম্পানী থেকে টাকা লোপাট করে বীমা গ্রহীতা ও ব্যক্তিগত স্বার্থ হাসিল করছে।
৪। কারা আইডিআরএ’র ট্যারিফ রেট ভায়োলেট করে কম রেটে বীমা গ্রহীতাদের সুযোগ সুবিধা দিয়ে অন্যের ব্যবসা ছিনিয়ে নিচ্ছে।
৫। কারা ষ্ট্যাম্প এ্যাক্ট এর মাধ্যমে বীমা গ্রহীতাদের সুবিধা দিয়ে ষ্ট্যাম্প এর টাকা ফাঁকি দিচ্ছে।
৬।ডামী কর্মী নিয়োগের মাধ্যমে কোম্পানী থেকে শত কোটি টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে যা খতিয়ে দেখতে হবে।
মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনা নিজেকে বীমা পরিবারের সদস্য হিসাবে পরিচয় দেন। আর তাই বীমা শিল্পে বঙ্গবন্ধুর যোগদানকে অভিস্মরণীয় করে রাখতে তিনি ২০২০ সালে “১লা মার্চকে বীমা দিবস হিসাবে স্বীকৃতি দিয়েছেন। এটা বীমা পেশাজীবিদের জন্য বড় অর্জন। আমরা যেন এই অর্জনকে ম্লান না করি”।
তাছাড়া বঙ্গবন্ধু পরিবারের বয়োজ্যাষ্ঠ মুরুব্বী জনাব শেখ কবির হোসেন স্যার প্রতিনিয়ত বীমা শিল্পে শৃংখলা আনয়নে তার সহযোগীদের নিয়ে আপ্রাণ চেষ্টা করে যাচ্ছেন। মাননীয় অর্থমন্ত্রী, বিআইএ’র নেতৃবৃন্দ, আইডিআরএ’র বিচক্ষণ চেয়ারম্যান ও বিশেষ বিশেষ ক্ষেত্রে অভিজ্ঞ তাঁর সহযোগীদের উদ্যোগকে স্বাগত জানাই। বীমা শিল্পের পরিচালকগণ ও মূখ্য নির্বাহী কর্মকর্তাগণ যদি সৎ ও স্বচ্ছতার পরিচয় দেয় এবং লোভকে সংবরণ করে। তাহলে অবশ্যি বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সঠিক বাস্তবায়ন সময়ের ব্যাপার মাত্র। তাই আসুন আমরা যারা মাঠে ময়দানে কাজ করি ঐক্যবদ্ধভাবে নীতি-নৈতিকতার মাধ্যমে জাতির জনকের স্বপ্ন বাস্তবায়নে আন্তরিকতার পরিচয় দেই।
লেখক: মীর নাজিম উদ্দিন আহমেদ, ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও সিইও, ইসলামী কমার্শিয়াল ইন্স্যুরেন্স কোঃ লিঃ