কামাল হোসেন শাহীন
তখন লালমোহন বাজারের অলিগলি চেনাও একটা বড় অর্জন। প্রাইমারি স্কুলের নিম্ম শ্রেনীতে পড়ি। বড়দের সাথে কালেভদ্রে হাটে বাজারে যাই। তখনকার সময়ের ঘটনা। বাজারে চোর ধরে অনেকগুলো মানুষের সামনে আয়োজন করে পিটাতে দেখেছি। চোর পিটানোর সময় অভিজ্ঞজন খুব সচেতনভাবে চোর পিটাতো। খুব খেয়াল রাখতো যেন চোর মরে না যায় কিংবা হাড়গোড় যেন একেবারে ভেঙে না যায়। শতশত চোখ আনন্দিত হয়ে সে উৎসব উপলব্ধি করেছে। দর্শকদের মধ্য থেকে কেউ কেউ স্বপ্রণোদিত হয়ে মারে অংশগ্রহণ করতো যেন অনেকটা যাত্রাপালায় নাচের সময় দর্শকদের কেউ কেউর মঞ্চে উঠে যাওয়ার মতো।
৮৭ সালের ঘটনা। ইউনিয়ন পরিষদের নির্বাচন। অবস্থানগত কারনে আমাদের বাড়ির দুপাশে দুই ইউনিয়নের ভোটকেন্দ্র। আমাদের বংশের লোকজন দুই ইউনিয়নের ভোটার। দাদার সাথে কালমা ইউনিয়নের ভোটকেন্দ্রে দিয়ে সেখান থেকে ফিরে আসি সোজাপথে বদরপুরের এক কেন্দ্রে। কেন্দ্রের একেবারে কাছাকাছি এলেই দেখি একগ্রুপ ভোটকেন্দ্র দখল করতে গ্রাম্য অস্রহাতে এগিয়ে যাচ্ছে। তারা ভোটকেন্দ্র দখল করে সিল টাকাতে থাকে। খবর চলে যায় পার্শ্ববর্তী কেন্দ্রে। শুকনো বিলের পথে এগিয়ে আসে শতশত মানুষ। দখলদাররা উপায় না পেয়ে ভোটবাক্স নিয়ে পালায় পার্শ্ববর্তী বাড়ির ঘরের পাটাতনে। প্রতিপক্ষরা সেই বাড়িতে হামলা চালায়। অনেক নাটকীয়তা শেষে দুইজনের নির্মম মৃত্যু হয়। মৃত্যু ঘটনার সেই নির্মমতার কাহিনী অন্তত এ জীবনে ভুলবনা। এত নির্মমভাবে মানুষ মানুষকে হত্যা করে, ভাবলেই ভেতরে হাহাকার করে উঠে। সারাদিন ভোট কেন্দ্রে পরে থাকে অত্যন্ত নির্মমভাবে হত্যা হওয়া দুটো মানুষ। যাদের একজন ঐ সমাজের বেশ পরিচিত ও ক্ষমতাশালী ছিলেন অন্যজন ছিলেন ঐ নির্বাচনে মই প্রতীকে নির্বাচন করা প্রার্থী। ঐ হত্যাকাণ্ডের বেশ সংখ্যক আসামী নানা চড়াই-উৎরাই শেষে মুক্তি পেয়েছে। আমার কী মনে হয় জানেন? সেদিন ঐ এলাকার সকল বাসিন্দা মৃত্যু উৎসবে মেতে উঠেছিল। যেন এক পরম দায়িত্ব সকলের!
চোরের চোখ উপরে ফেলার কাহিনী আমাদের কাছে কত উৎসাহ নিয়ে বলেছেন বড়রা! কোন চোরকে কী পদ্ধতিতে অন্ধ করে দেওয়া হয়েছে, সেখানে কতশত উৎসাহী মানুষের অংশগ্রহণ ছিল, সে কাহিনী যেন আমাদের অতীত গৌরবের জ্বলন্ত ইতিহাস!
অনার্সে পড়ার সময় প্রতিপক্ষ রাজনৈতিক ছাত্র সংগঠনের নেতা কর্মীদের মাইর দেয়ার উৎসব দেখেছি। যেখানে পাও সেখানেই মার। ধরে এনে মাইর। একদিন দুপুরবেল হঠাৎ করে কেউ চিৎকার করে উঠলো ধর, ধর। মাঠ থেকে ছেলেটিকে ধরে এনে উৎসবমুখর পরিবেশে মার দিতে সকলের কতই না সম্মিলিত অংশগ্রহণ!
ছেলেধরা সন্দেহে নিরীহ রানু বেগমকে মেরে ফেলার ঘটনাতো সেদিনের।
এত এত মানুষের মধ্যে সত্যিকারের মানুষের মন নিয়ে কেউ এগিয়ে আসেনা কেন? সবাই কি তখন রক্তের নেশায় মত্ত থাকে? রক্ত ঝরানো কিংবা খুনও কি নেশা যেটা হঠাৎ করে আমাদের অবচেতন মনকে অবশ করে দেয়। তখন সকলের সাথে রক্তের হলি খেলা শুরু করি আমরাও!!