Tuesday, November 5, 2024
Homeআন্তর্জাতিককোন দিকে হাঁটছে তুরস্ক?

কোন দিকে হাঁটছে তুরস্ক?

গত দুই তিন সপ্তাহে কত কী না ঘটে গেল। আমেরিকার নির্বাচনে ডোনাল্ড ট্রাম্পের বিরুদ্ধে জো বাইডেনের বিজয়, নাগরনো কারাবাখ যুদ্ধে আর্মেনিয়ার বিরুদ্ধে আজারবাইজানের জয়, ফ্রান্সের বিরুদ্ধে সারা মুসলিম বিশ্বে জনরোষ, করোনাভাইরাসের নতুন করে ছড়িয়ে পড়ে!

এসব কিছুই সারা বিশ্বের রাজনীতিতে বিশেষ করে মধ্যপ্রাচ্য এবং ইউরেশিয়া অঞ্চলে ব্যাপক প্রভাব ফেলছে। এই অঞ্চলের গুরুত্বপূর্ণ সবগুলো দেশই নতুন করে ছক আঁকতে শুরু করেছে।

ট্রাম্পের শাসনামলে যে স্টাইলে ভূ-রাজনৈতিক পরিস্থিতির মোকাবেলা করা হত বাইডেনের সময় সেই নিয়ম চলবে না।  এর আগের লেখাও আমি বলেছিলাম বাইডেনের বিজয় এই অঞ্চলের রাজনীতি এবং আঞ্চলিক সম্পর্কে নতুন মোড় নিয়ে আসবে।

যেমন তুরস্কের কথাই যদি ধরা হয়। তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়্যিপ এরদোগানের গত দুই সপ্তাহের বক্তব্য এবং দেশের মধ্যে ব্যাপক অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক পরিবর্তনের আভাস, বিচার বিভাগে সংস্কারের পরিকল্পনা এসবই আঙ্কারার নতুন বিশ্ব পরিস্থিতি মোকাবেলার প্রস্তুতিরই অংশ বিশেষ। 

ইউরোপ এবং আমেরিকার সঙ্গে তুরস্কের গত প্রায় পাঁচ বছর ধরের চলা ভঙ্গুর সম্পর্ককে নতুন করে জোড়া লাগানোর উদ্দেশ্যে এরদোগান পশ্চিমাদের সঙ্গে সমঝোতার আভাস দেন।

এরদোগানের পশ্চিমা নীতির পেছনে কী আছে?

তুরস্কের অর্থনীতি গত কয়েক বছর ধরেই খুব খারাপ যাচ্ছিল। ২০০৩ সাল থেকে যে এরদোগানের নেতৃত্বে তুরস্ক তার অর্থনীতিতে চমক দেখিয়ে বিশ্বের ১৫তম  স্থানে চলে এসেছিল।  তুর্কিরা অর্থনৈতিক স্বাচ্ছন্দ্যের আনন্দে আত্মহারা হয়েছিল। সেই এরদোগানের নেতৃত্বেই  আবার অর্থনীতির ধস নেমে এসেছে।  প্রায় ২০ বছর ধরে গণতান্ত্রিক পন্থায় নির্বাচনের মাধ্যমে একটানা ক্ষমতায় থাকার পিছেন অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ও সার্বিক জীবনমানের উন্নতি প্রধান ভূমিকা পালন করে আসছিল।

এখন ডলারের বিপরীতে মুদ্রার মূল্যহ্রাস, বাজার মূল্যের ঊর্ধ্বগতি, ক্রমবর্ধমান বেকারত্বের হার, এসবকিছু ক্ষমতাসীন এরদোগানকে ভাবিয়ে তুলেছে। 

অর্থনৈতিক সমস্যার জন্য অনেকগুলো কারণ থাকলেও মূল কারণ ছিল পশ্চিমাদের সঙ্গে তার ‘সাপে-নেউলে সম্পর্ক’। সুদের বিরুদ্ধে তিনি যুদ্ধ ঘোষণা করেছিলেন।  কিন্তু আন্তর্জাতিক সুদ চক্র তার অর্থিনীতির গলা এমনভাবে চেপে ধরেছিল যে শেষ পর্যন্ত তাকেই হার মানতে হল।  আন্তর্জাতিক পুঁজিবাজার আর বিনিয়োগকারীদের সবগুলো দাবি তিনি মেনে নিলেন।

যেমন, তার জামাতাকে অর্থমন্ত্রীর পদ থেকে সরিয়ে দিলেন। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ওপর থেকে তার নিয়ন্ত্রণ কমিয়ে ব্যাংকটিকে পূর্ণ স্বায়ত্তশাসন দিয়ে দেওয়ার আশ্বাস দিলেন যাতে ব্যাংকটি আন্তর্জাতিক অর্থনৈতিক অঙ্গনের চাহিদামত সুদের হার বাড়াতে পারে।

২০১৬ সালের ব্যর্থ সামরিক অভ্যূথানের পরে দেশের ভেতরে আইনের শাসন নিয়ে অনেক মহলে নানা প্রশ্নের জন্ম দিয়েছিল। সুতরাং আইন ও বিচার বিভাগে সংস্কারের দাবি ছিল অনেক দিনের। সেটাও তিনি মেনে নিলেন।

অনেক দিন ধরে ইউরোপের সঙ্গে চলছিল অবিশ্বাস। তুরস্ক যেমন ইউরোপের কোনো প্রতিশ্রুতি বিশ্বাস করতে পারেনি ইউরোপও তেমনি বিভিন্ন দিক দিয়ে তুরস্ককে ঘায়েল করার চেষ্টা করেছে। ফলশ্রুতিতে তুরস্ক ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ) থেকে আস্তে আস্তে দূরে সরে এসেছে।

পরে মুসলিম বিশ্বকে নিয়ে নতুন এক বলয় তৈরির চেষ্টা করছিল তুরস্ক। কিন্তু সেখানে বড় বাধা হয়ে দাঁড়ায় সৌদি রাজপুত্র মোহাম্মদ বিন সালমান, আবু ধাবির ক্রাউন প্রিন্স শেখ মোহাম্মদ বিন জায়েদ আল নাহিয়ান এবং মিশরের স্বৈরশাসক জেনারেল আবদেল ফাত্তাহ আস-সিসি।

এ কারণে তুরস্ক আবার ফিরে যেতে চাচ্ছে পশ্চিমা বলয়ে।

গত সপ্তাহে এরদোগান তো সরাসরি ঘোষণাই দিলেন যে ‘তুর্কীরা নিজেদেরকে ইউরোপের অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসেবে মনে করে।  তুরস্কের ভবিষ্যত, তুরস্কের ভাগ্য ইউরোপের সঙ্গে একই সুতায় বাঁধা।‘ 

তিনি ন্যাটোর কথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে এই সামরিক জোটে তার দেশের অবদানের কথাও তুলে ধরেন। যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে আরও ঘনিষ্ট সম্পর্ক স্থাপনের ঘোষণা দেন।  শুধু কিছু বক্তব্য দিয়েই শান্ত হননি এরদোগান। তিনি তার মেসেজ আরো স্পষ্ট করে তুলে ধরার জন্য তার প্রধান উপদেষ্টা ইব্রাহিম কালিনকে ইইউর হেড কোয়ার্টারে পাঠান। কালিন সেখানে ইইউর প্রধানদের সঙ্গে বৈঠকে তুরস্কের আগ্রহের কথাগুলো তুলে ধরেন।

তবে ইউরোপীয় ইউনিয়নের নেতারা এরদোগানের ভাষণ আর কালিনের বৈঠকে কতটা কনভিন্সড হয়েছে তা বুঝতে আরও দুই সপ্তাহ অপেক্ষা করতে হবে। কারণ, ডিসেম্বরের ১০-১১ তারিখ ইইউ নেতাদের শীর্ষ সম্মেলনে তুরস্কের বিরুদ্ধে কিছু অবরোধ-নিষেধাজ্ঞা জারির কথা রয়েছে।

আমেরিকা থেকে এখনই তুরস্ক বিরোধী কোনো সিদ্ধান্ত আসার সম্ভাবনা কম।  কিন্তু ইইউ-তুরস্ক সম্পর্ক আগামী কয়েক দিনে নতুন মোড় নিতে পারে।

ইইউ-তুরস্ক সম্পর্কে তিনটি প্রধান সমস্যা

ইউরোপীয় ইউনিয়নের সঙ্গে তুরস্কের সম্পর্কের ক্ষেত্রে তিনটি প্রধান সমস্যা হল:

এক. তুরস্কের সঙ্গে ফ্রান্স এবং অস্ট্রিয়াসহ কিছু ইইউ সদস্য দেশের মুসলমান এবং তুর্কী বিরোধী কট্টর মনোভাবের কারণে উদ্ভূত দ্বিপাক্ষিক সমস্যা। 

দুই. পূর্ব ভূমধ্যসাগরে জলসীমা এবং খনিজ সম্পদ নিয়ে তুরস্কের সঙ্গে গ্রীস এবং গ্রীক সাইপ্রাসের সঙ্গে স্বার্থ সংশ্লিষ্ঠ দ্বন্দ্ব। 

 তিন. তুরস্কে অবস্থানরত ৪০ লাখেরও বেশি সিরীয় শরণার্থী এবং তাদের নিয়ে ইইউর সঙ্গে আঙ্কারার চুক্তি ।

তুরস্কের বিরুদ্ধে ইইউর অবরোধ নিষেধাজ্ঞা কতটা ফলপ্রসূ হবে? 

উপরোক্ত বিষয়গুলোর মধ্যে যে বিষয়টি আঙ্কার জন্য সবচেয়ে বেশি মাথাব্যথার কারণ হতে পারে তা হলো পূর্ব ভূমধ্যসাগরে ক্রমবর্ধমান উত্তেজনা।

ইইউ নেতৃবৃন্দ ১০-১১ ডিসেম্বরের শীর্ষ সম্মেলনে তুরস্কের বিরুদ্ধে অবরোধ আনার কথা ভাবছে। এক্ষেত্রে ভূমধ্যসাগরে গ্যাস অনুসন্ধানে নিয়োজিত তুরস্কের ওরুচ রেইস নামক জাহাজ এবং এর পাহারায় নিয়োজিত যুদ্ধ জাহাজগুলোকে ফেরত আনার দাবি জানিয়েছে ইউরোপ।

তুরস্ক ওই সম্মেলনের আগে জাহাজগুলোকে ভূমধ্যসাগর থেকে ফেরত আনার ইঙ্গিত দিয়েছে। কিন্তু এই ইঙ্গিতে বিশ্বাস করতে পারছে না ইউরোপ। কারণ অক্টোবর মাসেও এরকম একটি অবরোধের হুমকির মুখে ওরুচ রেইস জাহাজটিকে কয়েকদিন বন্দরের নোঙ্গর করে রেখেছিল আঙ্কারা। কিন্তু পরে আবার সাগরে পাঠায়। উত্তেজনা নতুন করে দানা বাঁধে।

এবার জার্মান চ্যান্সেলর অ্যাঞ্জেলা মের্কেলও  বলেছেন যে, পূর্ব ভূমধ্যসাগরীয় ইস্যুতে বিষয়গুলি সঠিক দিকে অগ্রসর হচ্ছে না, সুতরাং তুরস্কের বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞার সম্ভাবনা নিয়ে ১০ই ডিসেম্বর আলোচনা হবে।

ফ্রান্স আর অস্ট্রিয়া তো অনেকদিন ধরেই তুরস্কের বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা প্রস্তাবনা নিয়ে আসার চাপ দিচ্ছে ইইউকে।

তবে ইইউর অবরোধ-নিষেধাজ্ঞা তুরস্কের বিরুদ্ধে কতটুকু প্রভাব ফেলবে তা এখই বলা কঠিন। তবে তুরস্কের বিরুদ্ধে ইরানের মত সার্বিক অবরোধ আসার সম্ভাবনা নেই। কিছু কোম্পানি, ব্যক্তি, দু-একজন মন্ত্রী এবং হয়তো গ্যাস সন্ধানে নিয়োজিত তুর্কী জাহাজে কর্মরত প্রকৌশলীদের বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা আসতে পারে। এছাড়াও তুরস্কের প্রতিরক্ষা সরঞ্জাম প্রস্তুতকারক কোম্পানিগুলোর বিরুদ্ধে কিছু বিধিনিষেধ আসার আশংকা রয়েছে। কিছু ইইউ দেশ অবশ্য তুরস্কের বিরুদ্ধে সামরিক অস্ত্র বিক্রি নিষেধাজ্ঞা আরোপের ওপর জোর দিচ্ছে। তবে তুরস্কের নিজস্ব অস্ত্র তৈরির খাত যেভাবে অগ্রসর হচ্ছে তাতে এধরনের অবরোধের প্রভাব তেমন একটা পরবে না।  কিন্তু অর্থনৈতিক দিক দিয়ে বড় কোন অবরোধ আসলে তুরস্ক অনেক বড় ধরনের সমস্যায় পড়তে পারে। কারণ, তুরস্ক ইইউর সবচেয়ে বড় ব্যবসায়িক অংশীদারগুলোর একটি। তুরস্কের রফতানির প্রায় অর্ধেক যায় ইউরোপে। 

তুরস্ক কী চাচ্ছে ?

তুরস্ক চাচ্ছে ইইউ এবং আমেরিকার যেন আঙ্কারার সঙ্গে বৈষম্যমূলক আচরণ পরিহার করে।  গুরুত্বপূর্ণ এক ন্যাটো সদস্য হিসেবে যেন সঠিক মূল্যায়ন করা হয়। এবং ইইউর সঙ্গে যে অমীমাংসিত বিষয়গুলো আছে সেগুলোর দ্রুত সমাধান করা।

ইইউর সঙ্গে অমীমাংসিত বিষয়গুলোর শুরুতেই আসে আঙ্কারা-ব্রাসেলসের মধ্যে শুল্ক ইউনিয়ন চুক্তির নবায়ন। ১৯৯৫ সালে স্বাক্ষরিত এই চুক্তি নিয়ে তুরস্ক অনেক দিন ধরেই নবায়নের তাগিদ দিয়ে আসছে। কারণ চুক্তির পরে ইইউতে অনেক দেশ যুক্ত হয়েছে এবং আমদানি রপ্তানিতেও অনেক পরিবর্তন-পরিবর্ধন হয়েছে।

দুই. তুরস্কের জনগণের জন্য ভিসামুক্ত ইউরোপ ভ্রমণ। তুরস্কের ইইউ সদস্যপদ পাওয়া  প্রায় অসম্ভব হলেও আঙ্কারা-ব্রাসেলসের মধ্যে একটি চুক্তি হয়েছিল ২০১৫ সালে এবং সেই চুক্তি অনুযায়ী কিছু শর্তসাপেক্ষ তুরস্কের জনগণকে বিনা ভিসায় ইইউ ভ্রমণের সুযোগ দেওয়ার কথা ছিল। কিন্তু সে প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়ন হয়নি।

তিন. শরণার্থী ফেরত চুক্তির নবায়ন।  ২০১৫ সালের ওই চুক্তি অনুযায়ী তুরস্ক গ্রীস থেকে সিরিয়ার শরণার্থী ফেরত নিবে এবং ইইউ শরণার্থীদের ভরণপোষণ বাবদ তুরস্ককে ৬ বিলিয়ন ইউরো দিবে। তুরস্ক তার প্রতিশ্রুতি পালন করলেও ইইউ চুক্তি অনুযায়ী অর্থ পরিশোধ করেনি।

তবে আপত দৃষ্টিতে গত কয়েক সপ্তাহে আঙ্কারায় সংস্কারের যে হাওয়া বইছে তাতে তুরস্কের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্র এবং ইইউর সম্পর্ক উন্নয়নের ইঙ্গিত দিলেও বর্তমান পরিস্থিতির খুব বেশি পরিবর্তন হবে বলে আমার মনে হয় না। তুরস্ক ইউরোপ বা আমেরিকার চাহিদা মত তাদের আজ্ঞাবহ সেবক হিসবে কাজ করবে না আর আমেরিকা-ইউরোপও তুরস্কের চাওয়াগুলো পূরণ করবে না।

সূত্র: যুগান্তর

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

- Advertisment -

সর্বাধিক জনপ্রিয়

সাম্প্রতিক মন্তব্য