শাহীন কামাল
রাজধানীর হলিক্রস স্কুল অ্যান্ড কলেজের ছাত্রী পারপিতা ফাইহার মৃত্যুর ঘটনায় তোলপাড় হয়ে উঠে নেট দুনিয়া। দেশের সকল মিডিয়ার সাথে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে নেটিজেনরা এই অনাকাঙ্ক্ষিত মৃত্যুতে নড়েচড়ে উঠে। নিজস্ব দৃষ্টিকোণ থেকে ঘটনার চুল-ছেঁড়া বিশ্লেষণ চলে। শিক্ষা সংক্রান্ত কর্তৃপক্ষ একাধিক তদন্ত কমিটি করে। এ সকল কমিটি তাদের রিপোর্ট দেয়ার আগেই দেশের বেশ সংখ্যক মানুষ এই আত্মহত্যায় জনৈক শিক্ষককে দোষী সাব্যস্ত করে। পারলে তারা তাকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে দেয়। ঘটনা পরবর্তীতে নানাবিধ রঙ মাখিয়ে পুরো দায় স্কুলকে দিয়ে তুলোধুনো করে।আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা নিয়েও মতামত দেয়া শুরু করে।
পারপিতার মৃত্যু পরবর্তী বলা হয়েছিল মেয়েটি ফাষ্টগার্ল ছিল। তাকে ইচ্ছাকৃত উচ্চতর গনিতে ফেল করানো হয়েছে। অথচ প্রকৃত সত্য হলো মেয়েটা প্রথম কাতারের স্টুডেন্ট ছিল না। প্রথম সাময়িক পরীক্ষায় সি ও ডি সেকশনের ৩৫ জন শিক্ষার্থী উচ্চতর গনিতে ফেল করে। দ্বিতীয় সাময়িক পরীক্ষায় ফেল করা শিক্ষার্থীর সংখ্যা ৫৫ জন। পারপিতা প্রথম সাময়িক পরীক্ষায় উচ্চতর গনিত ছাড়াও জীববিজ্ঞানে ফেল করে। দ্বিতীয় সাময়িক পরীক্ষায় সে এই দুই বিষয়ের সাথে গনিতেও অকৃতকার্য হয়। এই সময়ে একজন শিক্ষার্থী ফেল করতেই পারে। কিন্তু এই ফেল মেনে নেয়ার মতো মানষিক ও সামাজিক পরিস্থিতি মেয়েটির ছিল না। তার অভিভাবক তার সেই পথ রুদ্ধ করে রেখেছিল।
ফলাফল খারাপ হলে বকাবকি কিংবা মারের সংস্কৃতি বেশ পুরোনো। সময়ের সাথে এই ধ্যানধারণা অনেক পরিবর্তিত এখন। কিন্তু পারপিতার সাথে যেটা হয়েছিল তা দুঃখজনক। প্রথম সাময়িক পরীক্ষায় ফেল করার কারণে তার বাবা তাকে বেল্ট দিয়ে মেরেছিল বলে খবর আছে মিডিয়ায়।
তদন্ত কমিটি ইতিমধ্যে উত্তরপত্র পর্যালোচনা করে কোন অসংগতি পায়নি। অর্থাৎ মেয়েটিকে ইচ্ছাকৃত ফেল করানোর যে কথা বলা হয়েছে তা মিথ্যা। অথচ এই মিথ্যাকে আশ্রয় করে শিক্ষকদের বিরুদ্ধে কথা বলেছে যেনতেন পাশ করা ছেলেটিও৷ ফেইসবুকে শিক্ষাব্যবস্থা নিয়ে নানাবিধ মতামত দিয়েছে। এই দলটা অবশ্য সব বিষয়েই এভাবেই বলে। সরকারি কোন কর্মকর্তার কোন অন্যায়ে এরা যখন, তাদের যোগ্যতা নিয়ে কথা বলে তখন হাসি না এসে লজ্জা লাগে। এরা যখন বলে, নীলক্ষেত থেকে বই কিনে মুখস্থ করে বিসিএসে টিকে তখন দেখি যারা মন্তব্য করে তাদের কেউ কেউ একটা তৃতীয়/ চতুর্থ শ্রেণির সরকারি চাকুরী খুঁজতে খুঁজতে জীবন শেষ করে দিচ্ছে।
পারপিতার মৃত্যুটা আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে ভুল পেরেন্টিং এবং আমাদের আত্মকেন্দ্রিক জীবনযাপনের অন্ধকার দিক। মেয়েটি প্রথম সাময়িক পরীক্ষায় ফেল করার কারণে তার বাবা তাকে মেরেছে। ঘরে রয়েছে তার সৎ মা। ফলে এবার ফলাফল নিয়ে সে তার বাবামায়ের সামনে দাড়াতে পারেনি। আমাদের বর্তমান জীবনযাপনে সবাই আত্মীয়স্বজন থেকে দূরে সরে এসেছি অথবা দূর করে রেখেছি। দেখুন, আমাদের সময়ও ফলাফল খারাপ করলে বাবামা আমাদের কোলে তুলে নিয়ে নাচতেন না। কিন্তু একান্নবর্তী পরিবারের অন্য সদস্যরা তখন ঢাল হয়ে আশ্রয় হতো। মেয়েটার এমন কোন আত্মীয় কী ছিল না, যার কাছে মেয়েরা মন খুলে তার এই ভয়ের কথা বলতে পারতো? এর উত্তর হয়তো ‘ না’। কারণ এই স্বার্থপর দৃষ্টিভঙ্গির কারণে হয়তো মেয়েটা সেইসব বন্ধন থেকে দূরে থেকেছে। আমাদের সময়ও ফেল করার কারণে ভয়ে অনেকে বাড়ি থেকে পালিয়ে আত্মীয়ের বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছিল।
সন্তানের ফলাফল খারাপ হলে কিংবা আরও ভালো করার জন্য অভিভাবক ডাকা ভালো প্রতিষ্ঠানের বৈশিষ্ট্য। অথচ এটাকে নেতিবাচক হিসেবে দেখা হচ্ছে। ভিকারুননিসা, হলিক্রসসহ নামীদামী প্রতিষ্ঠানগুলোর এসকল নিয়মকানুনের জন্য অভিভাবক পছন্দ করে। আর একটা আত্মহত্যার কারণে পুরো সিস্টেম নিয়ে কথা হচ্ছে।
মেয়েটির বয়স সর্বোচ্চ কত হতে পারে? ১৪/১৫। কিশোর বয়সের এই অনাকাঙ্ক্ষিত অপ্রত্যাশিত মৃত্যু দেশে এই প্রথম নয়। আপনাদের মনে আছে নিশ্চয়, এদেশে এক নায়ক সালমান শাহর মৃত্যুতে বেশ কয়েকটি মেয়ে আত্মহত্যা করেছিল। কাকে দুষেছিলেন আপনি? এই যে পাখি ড্রেস কিনে না দেওয়ায় আত্মহত্যা করা মেয়েটির জন্য আপনি স্পেসিফিক কাউকে তো দোষ দেননি। প্রেমে বাঁধা দেওয়ায় আত্মহত্যা রোধ করতে আপনি এই বয়সী মেয়েদের ইচ্ছামতো বিয়ে করাকে সমর্থন করবেন?
শিক্ষকগণ ধোঁয়া তুলসীপাতা নয়। তাদের বিরুদ্ধে যে অভিযোগ উঠেছে তা কোন কোন সত্য। কিন্তু ঢালাও অভিযোগ এবং যেকোনো বিষয়ে দায় চাপিয়ে দেওয়ার সংস্কৃতি শুভ নয়। শিক্ষকদের হাতে শেকল চাপিয়ে উচ্চ জিপিএধারী জাতি হয়তো পাবেন কিন্তু প্রকৃত শিক্ষা কতটুকু অর্জিত হবে, তা দেখতে হয়তো আরও কয়েকবছর অপেক্ষা করতে হবে।
পিতামাতার অদূরদর্শিতা আর ভুল পেরেন্টিং এর কারণে একটা মেয়ের অনাকাঙ্ক্ষিত মৃত্যুতে আপনি পুরো শিক্ষকদের প্রতি আংগুল তুলেছেন, দেশের শিক্ষাব্যবস্থায় ক্ষত দেখা শুরু করেছেন, একজন নিরীহ শিক্ষককে কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়ে হত্যাকারী সাজাতে চাচ্ছেন, দেশের একটা বিখ্যাত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান নিয়ে বাজে কথা বলছেন, আপনার উদ্যেশ্য মহৎ না।