স্বাস্থ্যখাতের নানা অনিয়ম, দুর্নীতি এবং প্রথম আলোর জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক রোজিনা ইসলামকে হেনস্তার ঘটনায় সংসদে তোপের মুখে পড়েছেন স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক। তবে এ নিয়ে তিনি কোনো কথা বলেননি। এসব প্রসঙ্গ এড়িয়ে করোনা মোকাবেলায় বাংলাদেশ সফলতা দেখিয়েছে দাবি করে মন্ত্রী বলেন, দেশের মানুষের জীবনযাত্রা স্বাভাবিক রয়েছে। সাংসদ হারুন বলেন, ‘মানসম্মতভাবে সরকারের নিয়ন্ত্রণে যদি টিকা উন্মুক্ত করে দেওয়া হয়, তাহলে আমরা আগামী এক বছরের মধ্যে ৮০ শতাংশ লোককে টিকার আওতায় আনতে পারব। আমি মনে করি সরকারের পাশাপাশি এখানে বেসরকারি ব্যবস্থাকে উন্মুক্ত করতে হবে। সেখানে দুর্নীতি থাকা চলবে না। স্বাস্থ্যখাতে কেনাকাটায় সবকিছু সুনির্দিষ্টভাবে জানতে চাই।’
সোমবার জাতীয় সংসদে ২০২০-২১ অর্থবছরের সম্পূরক বাজেটের ওপর আলোচনায় ও ছাঁটাই প্রস্তাবের ওপর আলোচনায় অংশ নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেন সংসদ সদস্যরা। এ সময় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা উপস্থিত ছিলেন।
জাতীয় পার্টি চেয়ারম্যান ও সংসদে বিরোধীদলীয় উপনেতা জিএম কাদের বলেন, ‘যারা পুকুর চুরি করছেন, তারা বেরিয়ে যাচ্ছেন। যারা এসব প্রকাশ করছেন, তারা নানা সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছেন। অনুসন্ধানী সাংবাদিকতা জবাবদিহি নিশ্চিতে কাজ করে। সাংবাদিকদের এটুকু সুযোগ দেওয়া সমাজের দায়িত্ব।’
তিনি আরও বলেন, ‘প্রস্তাবিত বাজেটে স্বাস্থ্যখাতে বরাদ্দ জিডিপির শূন্য দশমিক ৮৩ শতাংশ। এটা ৪ থেকে ৫ শতাংশ দেওয়া উচিত ছিল। করোনা মহামারির কারণে বাড়ানো উচিত ছিল। কমপক্ষে জিডিপির ২ শতাংশ উচিত। করোনা নিয়ন্ত্রণে এলে অর্থনীতি চাঙ্গা হবে। তাই স্বাস্থ্যের দিকে খেয়াল করতে হবে। এটাকে অবহেলা করা উচিত নয়। কিন্তু অবহেলা করা হচ্ছে।’
আলোচনায় অংশ নিয়ে বিএনপির সংসদ সদস্য হারুন অর রশীদ বলেন, ‘স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়কে ঢেলে সাজাতে হবে। এটা সংস্কার করত হবে। বাংলাদেশের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় দুর্নীতির ডিপো। এই দুর্নীতি কীভাবে সংস্কার করবেন, এ ব্যাপারে আমাদের সুস্পষ্টভাবে জানাবেন স্বাস্থ্যমন্ত্রী।’
তিনি বলেন, ‘স্বাস্থ্য বিভাগ সত্যিকারভাবে আজ ভারতনির্ভর হয়ে গেছে। এতে বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার ভারতে চলে যাচ্ছে। যদি আমরা সত্যিকার অর্থে স্বাস্থ্য বিভাগকে ঢেলে সাজাতে পারি, সংস্কার করতে পারি তাহলে বিদেশে স্বাস্থ্যখাতে যে ব্যাপক টাকা চলে যায়, তা যাবে না।’
জাতীয় পার্টির রওশন আরা মান্নান বলেন, ‘স্বাস্থ্যখাতে নজর দিলে দেখা যাবে, এখানে অস্বাস্থ্যকর কাজকর্মই বেশি। স্বাস্থ্যখাতের আফজালরা নতুন রূপকথার মতো গল্প ও অনিয়ম করছে। যদিও বর্তমানে স্বাস্থ্যমন্ত্রী ও প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপে কিছুটা কমে আসছে। কিন্তু তারপরও থামানো যাচ্ছে না। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের লোকজন বলছেন স্বাস্থ্যখাতে আফজাল-মালেকরা ছাড়াও সেখানে অনেক মালেক ও আফজাল আছে। এগুলো শক্ত হাতে দমন করতে হবে। একজন নারী উপসচিবের কানাডা ও বিশ্বের অন্যান্য দেশে তিন-চারটা বাড়ি আছে।’
বিএনপির সংরক্ষিত নারী আসনের সংসদ সদস্য ব্যারিস্টার রুমিন ফারহানা বলেন, ‘করোনাকাল হওয়া সত্ত্বেও এ বছর আমরা স্বাস্থ্য ও শিক্ষার মতো বেসিক জিনিসগুলোর ওপর যদি নজর না দেই, ভৌত অবকাঠামোর দিকে যদি আমরা সারাদিন তাকিয়ে থাকি, তাহলে করোনা বলেন আর যাই বলেন দেশের সাধারণ মানুষের কোনো উপকার হবে না। ১০ হাজার মানুষের মাথাপিছু ডাক্তার আছে মাত্র পাঁচজন। আর নার্স আছে মাত্র তিনজন। এই অপ্রতুল জনগণ নিয়ে কীভাবে হাসপাতালগুলো চলবে? কীভাবে আমরা স্বাস্থ্যখাতকে ঢেলে সাজাবো? কীভাবে আমরা সাধারণ মানুষকে সেবা দেবো?’
একই দলের কাজী ফিরোজ রশীদ বলেন, ‘আমাদের অক্সিজেন নেই, অক্সিজেন প্ল্যান্ট জেনারেট করতে হবে। সাংবাদিক রোজিনার নাম না নিয়ে তিনি বলেন, সে যদি চুরি-ডাকাতি করে, সাংবাদিককে গ্রেফতার করতে পারেন, তাকে পুলিশে দেবেন—এটাই নিয়ম। আইন নিজের হাতে কেন তুলে নেবেন? আপনিতো সচিবালয়ের বড় কর্মকর্তা। আপনি কেন নিজের হাতে আইন তুলে নিলেন? আপনি সাংবাদিককে নাস্তানাবুদ করলেন কেন? ছয় ঘণ্টা তাকে টয়লেটে যেতে দেননি। একজন অসুস্থ মানুষ। তাও নারী। তাকে এভাবে হেনস্তা করলেন! এ নিয়ে জাতিসংঘ কথা বলল। সারাবিশ্ব কথা বলল। আমাদের মুখটা কোথায় রইল? নিজেদের দুর্বলতা নিজেদের ঢাকতে হয়। ওখানে যদি তার কাছ থেকে মুচলেকা নিয়ে ছেড়ে দিতেন, যে আপনি আর জীবনে কখনো সচিবালয় ঢুকতে পারবেন না, এটা পৃথিবীর আর কেউ জানত না। এটা না করে আপনারা এমনভাবে জাহির করলেন, এখন আপনাদের যত যা আছে দুর্বলতা প্রতিদিন প্রকাশ পাচ্ছে। সামনে আমরা মহাবিপদ দেখছি। এভাবে বিপদ থেকে কীভাবে রক্ষা পাব, এখন থেকে আমাদের সিদ্ধান্ত নিতে হবে।’
সাংবাদিক রোজিনা ইসলামকে হেনস্তার প্রসঙ্গ তুলে তিনি বলেন, ‘একজন নারী সাংবাদিক যদি অন্যায় করে থাকেন, তাহলে তাকে পুলিশে দিলো না কেন? তাকে ৬ ঘণ্টা নির্যাতন করে কেন পুলিশে দেওয়া হলো? আইন কেন নিজ হাতে তুলে নিল? দেশবাসী এটা নিয়ে অনেক বেশি সমালোচনা করছে।’
তবে সংসদ সদস্যদের এসব প্রশ্নের কোনো জবাব দেননি স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক। তিনি এ প্রসঙ্গ এড়িয়ে বলেন, ‘স্বাস্থ্যসেবা একটি ব্যাপক কর্মযজ্ঞ। দেড় বছর ধরে করোনা চলছে। তারা সেবা দিয়ে যাচ্ছেন।’ করোনা মোকাবেলায় সরকারের বিভিন্ন উদ্যোগের কথা তুলে ধরে স্বাস্থ্যমন্ত্রী বলেন, ‘ওষুধের কোনো ঘাটতি হয়নি। অক্সিজেনের অভাব কখনোই হয়নি। আমেরিকায় যে চিকিৎসা এখানেও একই চিকিৎসা হয়েছে। ভ্যাকসিন কার্যক্রম চলমান আছে। এসব কারণে মৃত্যুর হার দেড় শতাংশ। বিশ্বে এই হার আড়াই শতাংশ।’