Friday, November 14, 2025
Homeস্মরণএকজন শিক্ষাবীদ ও রাজনীতিবিদ অধ্যক্ষ নজরুল ইসলামের বিদায়

একজন শিক্ষাবীদ ও রাজনীতিবিদ অধ্যক্ষ নজরুল ইসলামের বিদায়

শাহীন কামাল

শাহীন কামাল :

লালমোহনের রাজনৈতিক মঞ্চে দীর্ঘদিন প্রভাবশালী ব্যক্তি হিসেবে অধ্যক্ষ এ কে এম নজরুল ইসলাম সর্বজনবিদিত। স্বাধীনতা পরবর্তী সময় থেকে অদ্যাবধি লালমোহনের সাম্প্রতিক রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে ‘প্রিন্সিপাল নজরুল ‘ কিংবা ‘ নসু মিয়া’ এক অতিব গুরুত্বপূর্ন চরিত্র। কখনো রাজনৈতিক মঞ্চে প্রত্যক্ষ ভুমিকা কখনো পরোক্ষভাবে রাজনৈতিক নীতিনির্ধারণীতে অধ্যক্ষ নজরুলের ছিল সচল উপস্থিতি। দীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনে নন্দিত হয়েছেন নিজস্ব কারিশমায়, নিন্দিত হয়ে বিরোধী শিবিরের কাছে। কিন্তু ব্যক্তি নজরুল ছিলেন অসহায়ের আশ্রয়স্থল। রাজনীতির এই দীর্ঘপথ পরিক্রমায় প্রাপ্তি যেমন ছিল তেমন অপ্রাপ্তিও কম ছিল না। রাজনৈতিক আকাশে সাময়িক দুর্ভাগ্য তাকে দমিয়ে রেখেছে হয়তো কিন্তু থামিয়ে দিতে পারেনি।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে রসায়ন শাস্ত্রে স্নাতকোত্তর করে কাস্টমসে কর্মজীবন শুরু করলেও শাহবাজপুর কলেজের অধ্যক্ষ হিসেবে তিনি সর্বাধিক পরিচিত। মূলত লালমোহনের সাবেক এমপি মোতাহার মাষ্টারের অনুপ্রেরণায় রাজনীতির পিচ্ছিল পথে পা বাড়ান তিনি। শিক্ষকতার পাশাপাশি সামাজিক ও রাজনৈতিক বিষয়ে নেতৃত্বে ধাপে ধাপে প্রত্যক্ষ রাজনীতিতে আবির্ভূত হন তিনি। ১৯৮৫ সালে দেশের প্রথম উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে লালমোহনের তৎকালীন অধিকাংশ প্রভাবশালী ব্যক্তির বিরোধিতা স্বত্বেও জনগণের প্রকৃত ভালোবাসায় চেয়ারম্যান নির্বাচিত হোন। প্রথাগত নির্বাচনী প্রচারণার পরিবর্তে পোষ্টার, ব্যানার, ফেস্টুন এবং শোভাযাত্রা না করে ব্যক্তিগত পর্যায়ের যোগাযোগ তথা ভোটপ্রার্থনায় তিনি আজীবন নিজস্ব ধরণ ধরে রেখে সফলকাম হয়েছেন। ফলে লালমোহনের প্রায় প্রতিটি বাড়ির ব্যক্তি থেকে ব্যক্তি পর্যায়ে পৌঁছেছেন তিনি। সাধারণ মানুষের সাথে কথা বলার সময় তিনি ঐ ব্যক্তির বাপ দাদার পরিচয় নিমেষে বলে দিতে পারতেন।

কালে কালে রাজনৈতিক মঞ্চে প্রভাবশালী হয়ে উঠেন তিনি। উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান হয়েছেন তিনবার। দলীয় ব্যানারের পরিবর্তে ব্যক্তি পরিচয়ে তিনি স্বকীয়তা দেখিয়েছেন।

শিক্ষকতা ও রাজনৈতিক পরিচয়ের বাইরে তিনি একজন সফল কৃষি উদ্যোক্তা। রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে স্বীকৃতিও পেয়েছেন। সেই প্রায় তিন দশক আগে থেকেই মাছ ও মুরগী চাষে জড়িয়ে পড়েছিলেন তিনি। তার সাথে সাক্ষাৎকারে আসা লোকজনের জন্য বাসা ছাড়া তার দ্বিতীয় ঠিকানা ছিল চরপাংকি যেখানে তিনি কৃষি শ্রমিকদের ন্যায় ব্যস্ত সময় কাটাতেন। রাজনৈতিক অসময়ে কৃষি কাজ নিয়েই ব্যস্ত থাকতেন তিনি।

শিক্ষকতা আর রাজনৈতিক যুগপৎ কাজে যখন তিনি ব্যস্ত সময় কাটাচ্ছেন তখন আমি শাহবাজপুর কলেজের একাদশ শ্রেণির শিক্ষার্থী। ৯২ সালের তার রাজনৈতিক জীবনের চড়াই-উতরাই দেখেছি কাছ থেকে। একাদশ শ্রেণিতে মাঝেমধ্যে ইংরেজি পড়াতেন আমাদের ক্লাসে। প্র‍তি ক্লাসে আমাকে দাঁড় করিয়ে পড়া জিজ্ঞেস করতেন। প্রায়ই একটা হলুদ শার্ট পড়ে ক্লাস করার কারণে মাঝেমধ্যে এই ‘ইওলো শার্ট’ বলে দাঁড় করাতেন। অধ্যক্ষের রুমে ডেকে নিয়ে পড়াশোনার খোঁজ খবর নিতেন। স্বপ্ন দেখাতেন।

লালমোহনের দীর্ঘ কয়েক বছরের সামাজিক রাজনৈতিক ব্যক্তিবর্গ যারা দাপুটের সঙ্গে লালমোহনের সেবা দিয়েছেন, দিচ্ছেন – তাদের প্রায় প্রত্যেকে অধ্যক্ষ নজরুলের ছাত্র কিংবা রাজনৈতিক শিষ্য। মত ও পথে বিভক্ত তার রাজনৈতিক প্রতিপক্ষও অধ্যক্ষ নজরুল ইসলামের এই রাজনৈতিক পরিচয়কে সম্মানের সাথে মেনে নিবেন।

১৯৪১ এ জন্মগ্রহণ করে প্রায় পাঁচ দশরের সচল রাজনৈতিক জীবনে অবসান হলো। তার এই দীর্ঘ শিক্ষকতা জীবনে অসংখ্য গুণী শিক্ষার্থী রেখে গেছেন। রাজনৈতিক জীবনে রেখেন অগণিত শিষ্য। পক্ষের যেমন আছেন তেমনি প্রতিপক্ষের দলটা ছোট নয়। সকলকে এক কাতারে রেখে অনন্তকালের পথে পাড়ি দিয়েছেন তিনি। তার এই শূন্যতায় কাছের লোক যেমন হারিয়েছেন সত্যিকারের সুহৃদ তেমনি বিরোধীরা সাহসী প্রতিপক্ষ হারিয়েছেন। এ শূন্যতা পুরো লালমোহনের জন্য অপূরনীয় ক্ষতি। লালমোহন সত্যিকার অর্থেই একজন রাজনৈতিক অবিভাবক হারিয়েছে।

লেখকঃ সহকারী অধ্যাপক, ইংরেজি বিভাগ, নাজিউর রহমান কলেজ, ভোলা।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

- Advertisment -

সর্বাধিক জনপ্রিয়

সাম্প্রতিক মন্তব্য