Friday, November 28, 2025
Homeমন্তব্যহারিয়ে যাচ্ছে পারিজাত তথা কাঁটা মান্দার

হারিয়ে যাচ্ছে পারিজাত তথা কাঁটা মান্দার

শাহীন কামাল

শীতের শুষ্কতা শেষে প্রকৃতি নবরূপে সজ্জিত হয়  ঋতুরাজ বসন্তের আগমনে। পলাশ, শিমুলের সাথে গ্রাম বাংলায় সৌন্দর্য বিলাতে আবির্ভাব হয় পারিজাতের৷ সভ্য সমাজে পারিজাতের আভিজাত্য নিয়ে খুব বেশি আলোচনা না হলেও রবীন্দ্রনাথ ঠিকই পারিজাতের রূপে মুগ্ধ হয়েছেন বারবার। তিনি বলেছেন  ফাগুন হাওয়ায় রঙে রঙে, পাগল ঝোরা লুকিয়ে ঝরে গোলাপজবাপারুলপলাশপারিজাতের বুকের পরে।গ্রাম বাংলায় সারাবছর অবহেলায় পরে থাকা মান্দার গাছ খ্যাত পারিজাত তার সবটুকু সৌন্দর্য নিয়ে দৃশ্যমান হয়ে ফুটে উঠে বসন্তের আগমনে। অপ্রয়োজনীয় ও উপেক্ষিত একসময়ে চিরচেনা ‘ ছাই ফেলতে ভাঙা কুলার’ মতো মান্দার গাছ আজ বিলুপ্তির পথে। একদা গ্রামাঞ্চলে নতুন বাড়ি তৈরিতে প্রথমেই মান্দার গাছ রোপণ করা হতো। বেড়া হিসেবে ব্যবহৃত এই গাছের ডাল রোপণ করলে সহজেই নতুন বাড়িতে বেষ্টনীর কাজ করতো।

অপেক্ষাকৃত বয়সী গাছের কান্ড দিয়ে তক্তা করে ব্যবহার করা হতো। শালিক আর বকের বংশবিস্তারের জন্য বাসা তৈরিতে এই গাছের শাখাই ছিল পছন্দের শীর্ষে। হয়তো দুষ্ট ছেলেদের থেকে প্রজন্ম রক্ষায় এই কাঁটাওয়ালা মান্দার গাছই ছিল সেরা। পাখিরা নিরাপত্তার জন্য বেঁছে নিতো মান্দার গাছ। চমকপ্রদ, মনোরম, সহজলভ্য ও জনপ্রিয় ফুলগাছ হিসেবে এর পরিচিতি রয়েছে ব্যাপক। থোকায় থোকায় রক্তিম লাল রঙের ফুল সবুজ পাতার উপরে দৃশ্যমান হয়।

নানা জাতের পারিজাত তথা মান্দার গাছের এই ফুল হাতে নিয়ে খেলা করে ছেলেমেয়েরা। এক একটা ফুলকে আলাদা করলে তখন মোরগের মতো দেখায়। হাতে ফুল ঘষলে লাল কিংবা খয়েরী রঙের দাগ পরে যেন মেহেদী রঙে রাঙিয়ে নিয়েছে হাত৷ ফাউন্টেন পেনের মুখ দিয়ে ফুল কেঁটে গোলাকার করে কপালে টিপ দিত মেয়েরা। কাঁটা মান্দার ফুল গ্রামের কিশোর-কিশোরীদের কাছে শুধু খেলনা বস্তু হিসেবেই নয়, কেউ কেউ খাবার হিসেবেও নিত একে। পাকা তেতুল, সরিষার তেল ও মান্দারের লাল ফুল চটকিয়ে এক প্রকার চাটনি তৈরি করা হতো যা ‘তেঁতুল বানানি’ নামে পরিচিত ছিল।নানা প্রজাতির মান্দার গাছের সমাহার ছিল আমাদের দেশে। তবে যে প্রজাতিটি দক্ষিণবঙ্গের মানুষের কাছে অতিপরিচিত, সেটি হলো কাঁটা মান্দার। কেউ কেউ এটিকে মাদার ও পানিয়া মান্দার নামেও চেনেন। উত্তরবঙ্গে খুব একটা দেখা যায়না। অপেক্ষাকৃত নীচু এলাকায় যত্নহীন ভাবে বেড়ে উঠে মান্দার গাছ। তাই যত্ন করার প্রয়োজন হয় না। জলের কাছের ঝোপঝাড় হিসেবেই বেড়ে ওঠে। কেউ কেটে না ফেললে অনেক বছর বাঁচে। আবার ডাল কেটে লাগালে গাছ হয়। স্বাদু জল ও জোয়ার-ভাটা এলাকায় ভালো জন্মে।  সময়ের সাথে পরিবর্তনের ছোঁয়া লেগেছে সর্বত্র। মেহগনি , শিশুসহ আগ্রাসী প্রজাতির গাছের কারণে মান্দার গাছ ধীরে ধীরে গ্রামবাংলা থেকে হারিয়ে যাচ্ছে। তা ছাড়া ইটের ভাটায় কাঠের জোগান ও দেশলাই তৈরিতে ব্যবহৃত হওয়ার কারণে পরিণত বয়সের মান্দার দেখা ভাগ্যের ব্যাপার। অন্য লাভজনক বৃক্ষ রোপণ করার কারণে এখন আর মান্দার গাছ রোপণ থেকে দৃষ্টি ফিরিয়েছে সকলে। এটি নরম কাণ্ডবিশিষ্ট বৃক্ষ। শাখা-প্রশাখা ফ্যাকাশে ধূসর। অসংখ্য কালো বর্ণের কাঁটা দ্বারা কাণ্ড পরিবেষ্টিত। বাকল গভীরভাবে ফাটা। পাতা সবুজ। দীর্ঘদিন পর হলদে হয়ে ঝরে পড়ে। শাখার আগায় ফুলের মঞ্জরি হয় এবং একটি মঞ্জরিতে একাধিক ফুল থাকে। পুষ্প টকটকে লাল কিংবা সিঁদুরে, উজ্জ্বল, ৩.৪—৪.৩ সেন্টিমিটার লম্বা। ফল পড, পাকলে বহিত্বক ফেটে বীজ চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে। বীজ কালো, বৃক্কাকার, মসৃণ। বাংলা ও গাঙ্গেও সমভূমি ও মিয়ানমারে আদি আবাস। এটির পরিবার Fabaceae। বৈজ্ঞানিক নাম erythrina fusca।

রবীন্দ্রনাথের তার বিখ্যাত গান, চাঁদের হাসির বাঁধ ভেঙেছে, উছলে পড়ে আলো….. গানের মধ্যে চমৎকার করে পারিজাতকে উপস্থাপন করেছেন-
“পারিজাতের কেশর নিয়ে ধরায়, শশী, ছড়াও কী এ।
ইন্দ্রপুরীর কোন্ রমণী বাসরপ্রদীপ জ্বালো ॥
…………
ও রজনীগন্ধা, তোমার গন্ধসুধা ঢালো ॥“

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

- Advertisment -

সর্বাধিক জনপ্রিয়

সাম্প্রতিক মন্তব্য