Friday, July 11, 2025
Homeমন্তব্যস্মৃতিচারণ ২১ শে আগস্ট, ২০০৪

স্মৃতিচারণ ২১ শে আগস্ট, ২০০৪


খালেদা বাহার বিউটি :

এক ভয়ংকর স্মৃতি হয়ে আছে , যেই স্মৃতির ট্রমা থেকে আজও বের হতে পারিনি।যখনই মনে পড়ে , হাত পা অবশ হয়ে আসে, নিঃশ্বাস ফেলতে কষ্ট হয়, বুকের ভিতরটা ভারী হয়ে উঠে।

সেদিন ছিলো জননেত্রী শেখ হাসিনার জনসভা। যথারীতি আমরা দুপুরের পর পরই বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউতে পৌঁছে যাই। প্রচন্ড ভিড় ছিলো সেদিন, লোকে লোকারন্য।অসম্ভব গরম পড়েছিলো । গাঁদাগাঁদি করে দাঁড়ানোর ফলে গরম আরো বেশী লাগছিলো।পুরো চত্বর ভরে গিয়েছিলো নেতা কর্মীদের সমাগমে।দাঁড়ানো যাচ্ছিলো না, আমার কেমন যেন খারাপ লাগছিলো গরমে। এত ঠাসাঠাসি অবস্থা ছিলো যে বের হওয়ার কোন উপায় নেই। আমি যখন দেখলাম কোনভাবেই ভিড় ঠেলে বের হতে পারবোনা তখন আমি মানসিকভাবে খুব ভীত হয়ে পড়ি। ভয়েই হয়তো আমার প্রচন্ড পিপাসা লেগেছিলো। সবার কাছে পানি চাইলাম, কেউ একফোঁটা পানি দিতে পারলোনা। অনেকক্ষন পরে আজকের ঢাকা মহানগর উত্তর মহিলা আওয়ামী লীগের সভানেত্রী দিপ্তী আপা অন্য মেয়েদের মাধ্যমে একটা পানির বোতল পাঠালেন কিন্তু সেই বোতল আমার হাতে যখন পৌঁছালো তখন তাতে একফোঁটা পানিও ছিলোনা। তখনো ঘটনাস্থলে নেত্রী এসে পৌছাননি। কোনরকমে ভিড়ের ভিতরে দাঁড়িয়ে থাকার চেষ্টা করে যাচ্ছি, কারন চারদিক থেকে চাপ দেওয়া হচ্ছিলো।সেদিন আমার মনে হচ্ছিলো এখান থেকে হয়তো আজ আর বেঁচে ফিরতে পারবোনা।এতো মিছিল , মিটিং এতো আন্দোলন সংগ্রাম করেছি সেদিনের মতো এমন আর কখনো মনে হয়নি। জননেত্রী শেখ হাসিনা সভাস্থলে যখন আসলেন এমন একটা হুলুস্থুল পড়ে গেলো, এমন চাপাচাপি শুরু হলো যে দাঁড়ানো যাচ্ছিলোনা। কিভাবে যে সেই প্রচন্ড ভিড়ের মধ্যে টিকে ছিলাম এখন তা চিন্তা করতেও পারছিনা। নেতৃবৃন্দের বক্তৃতা চলছে, স্লোগানে স্লোগানে মূখর! কেউ কারো কথা শোনার কোন অবকাশ নাই। আমার অনেক কষ্ট হচ্ছিলো, ঘেমে আমি একাকার! বের হওয়ার কোন ব্যবস্থাই নাই, আমি হতাশ হয়ে পড়লাম। নেত্রী বক্তৃতা দিতে শুরু করলেন, তখনতো স্লোগানের জোয়ার উঠলো, কারো দিকে কারো ভ্রক্ষেপ নাই হাততালী, স্লোগান আর ঠেলাঠেলী বেড়ে গেলো। চারদিকে এতো মানুষ যে কিচ্ছু দেখা যাচ্ছিলোনা। আমি ছিলাম ভিড়ের মধ্যে তাই আমার এমন অবস্থা হয়ে ছিলো। নেত্রীর বক্তৃতা চলছে। হঠাৎ আমি অনুভব করলাম কেউ একজন আমার হাত ধরে টানছে এবং কিছু বলছে। আমি একটু অবাক হয়ে গেলাম , কে এটা? ভালো করে তাকাতেই দেখি আমার শশুড়ের পুরনো ড্রাইভারের বউ নুরজাহান। নুরজাহান আমাকে বললো , ভাবী এখানে আপনি থাকতে পারবেন না, বের হন ,বের হন।আমার হাত শক্ত করে ধরে বলতে গেলে টেনে হিঁচড়ে নুরজাহান আমাকে বের করে আনার চেষ্টা করলো।

অনেক কসরত করে ভিড়ের মধ্য থেকে যখন আমাকে আওয়ামী লীগ অফিসের সামনের আইল্যান্ডের পাশে আনলো তখন আমি দেখলাম, আইভী রহমান আইল্যান্ডে দাঁড়িয়ে আছেন। উনি নীচে নামবেন এবং স্টেজের দিকে যাবেন। আমি জানতাম ওনার পায়ে ব্যাথা ।আমি হাত বাড়ালাম, উনি আমার হাতে হাত রাখলেন , উনি নীচে নামলেন আর আমি আইল্যান্ডে উঠলাম। মনে হচ্ছিলো আমার নাকে মুখে দমকা হাওয়ার ছোঁয়া লাগলো। আমরা সোজা হাঁটা শুরু করলাম। কিছুদূর যেতেই দেখলাম , অদূরে দাঁড়িয়ে আছেন বর্তমান ঢাকা মহানগর উত্তরের নেতা ওয়াকিল উদ্দীন ভাই , কাদেরখান ভাই সহ আমাদের গুলশান এলাকার অনেকেই। আমি বললাম , আমার খুব পানির পিপাসা লেগেছে, তখন ওয়াকীল ভাই কেউ একজনকে দিয়ে এক প্যাকেট পানি আমাকে দিলেন।এরকম প্যাকেটের পানি আমি আর কখনো দেখি নাই। প্রচন্ড পিপাসার্ত আমার কাছে সেই পানির স্বাদ ছিলো যেন অমৃত! আমি আর নুরজাহান সামনের দিকে এগিয়ে গেলাম, অল্প কিছুদূর যেতেই শুনছিলাম, নেত্রীর বক্তব্য শেষ তিনি বললেন জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু! হঠাৎ ধ্রীম্ ধ্রীম্ ধ্রীম্ কানফাটা শব্দ, ঘটনার আকস্বীকতায় আমরা হতভম্ব হয়ে গেলাম। মানুষজন দিকবিদিক ছোটাছুটি করছে। আমরা দুজন দৌড় দিয়ে আইল্যান্ডের পাশের একটি দোকানে, ঝাপ বন্ধ করে দিচ্ছিলো তখনই নীচু হয়ে ঢুকে পড়লাম।আর একটু দেরী হলে আমরা ঢুকতে পাড়তাম না।ঢুকে দেখি ছোট্র একটা দোকান কিন্তু অনেক লোক। আমি কান্না করছিলাম, নুরজাহান আমাকে ধরেই ছিলো। সবার চোখেমূখে উৎকন্ঠা, সবাই ভীতসন্ত্রস্থ। কিছুক্ষন পর দোকানের লোকরা আমাদেরকে বললো , আপনারা বের হয়ে যান ,এখন শান্ত, আমরা দোকান বন্ধ করে দিবো। আমরা বের হয়ে গেলাম। দেখলাম মানুষজন দৌড়াদৌড়ি করছে, মনে হলো আবারও বিকট শব্দ , আমরা দৌড়াচ্ছি । কোনদিকে যাবো বুঝছি না, শুধু দৌড়াচ্ছি আর ভয়ে কান্নাকরছি। মনে হয় আওয়ামী লীগ অফিসের পিছনের দিকে আমরা চলে গিয়েছিলাম। একটা বিল্ডিং এর ভিতর লোকজন আশ্রয় নিয়েছিলো। আমরা বললাম , আমাদেরকে একটু জায়গা দেন। কিন্তু কেউ জায়গা দিলোনা, কলাপসিবল গেইট বন্ধ ছিলো। লোকজন তখনো দৌড়াচ্ছিলো। আমরা পাগলের মতো ছুটছিলাম একটু আশ্রয়ের জন্য।আরো ভিতরদিকে চলে গেলাম, আমরা কিন্তু জানিনা , আমরা এখন কোথায়। সামনেই একটা নির্মানাধীন বিল্ডিং চোখে পড়লো, সেখানে আমরা ঢুকে পড়লাম। তখন শুধু শুনছিলাম এ্যামবুলেন্স আর পুলিশের গাড়ীর সাইরেন। আমরা যখন এখানে আসলাম তখন পড়ন্ত বিকাল।বঙ্গবন্ধু এ্যাভিনিউতে আসলেই কি হয়েছিলো আমরা কিছুই জানিনা।সবাই দৌড়াচ্ছে আমরাও দৌড়াচ্ছি। ভিতরে ঢুকতেই দেখলাম কয়েকজন লোক। আমরা ভয়ে জড়োসড়ো হয়ে আছি, ভাবলেশহীন,কিংকর্তব্যবিমূর। বিশাল বিল্ডিং। পুরোটা ফাঁকা। তখন খেয়াল হলো পায়ে জুতা নাই। একটু পড়ে সেখানে অল্প বয়সী একটা ছেলে আসলো আশ্রয় নিতে। একটু সাহস হলো কারন আগের লোকগুলো যেন কেমন! কিছুক্ষন পরে দেখলাম মধ্যবয়সী এক ভদ্রলোক এবং তাঁর স্ত্রী এসেছে, এরা আমাদের সাথে ঐ দোকানেও ছিলো। এদেরকে দেখে আর একটু সাহস হলো । এই দম্পতী দাড়িওয়ালা আর বোরখা পরিহিত ছিলো। আমি কেন জানি বেশি ভিতর দিকে যাচ্ছিলাম না। গাঁ ছমছম করছিলো। আগের লোকগুলো আমাদের সাথে কথা বলার চেষ্টা করছিলো। বলছিলো, হাজার হাজার লোক মরে গিয়েছে, শেখ হাসিনাকেও মেরে ফেলেছে। আমরা পুরো স্তব্দ হয়ে গেলাম। একজন লোক ছিলো বেশ মোটাসোটা, তার হাত থেকে রক্ত পড়ছিলো। আমি জিজ্ঞেস করলাম আপনার হাতে কি হয়েছে? উনি বললো- এইতো আপনাদের মতো লোকদের বাঁচাতে গিয়ে হাত কেটে ফেলেছি।আমরা পরে আসা ছেলেটিকে আমাদের সাথে সাথে থাকতে বললাম।কিন্তু কেনো যেন এই ছেলেটিকে আগের থেকে এখানে থাকা লোকগুলো পছন্দ করছিলো না। এরমধ্যে যুব মহিলা লীগের একটা মেয়ে এসে আমাদের সাথে যোগ দিলো। সেও আশ্রয়ের খোঁজে এখানে এসেছে।বললো,নাম পারভীন । আমরা চারজন হলাম। আর ঐ দম্পতী ভিতরে একটা ঘরে যেয়ে বসলো। আমি সবসময় মেইন দরজার দিকে খেয়াল রাখলাম।একটু পরে কি একটা কথা বলতেই আমাদের সাথের ছেলেটাকে আগের লোকদের মধ্যের মোটা লোকটি জোড়ে একটা থাপ্পর মারলো। একটু অবাক হয়ে গেলাম, কি ব্যাপার, কি হলো? ছেলেটির সাথ অহেতুক তর্কাতর্কি শুরু করলো । ছেলেটিও থাপ্পর খেয়ে একটু ভড়কে গেলো। ছেলেটি মনে হয় চলে গেলো। পরে আর দেখিনি ।লোকগুলো আমাদেরকে বললো ,আপনারা ছাদে উঠে যান। কোনদিকে বের হতে পারবেন না। পরিস্থিতি খুব খারাপ। লাশ নিয়ে কূল পাচ্ছেনা ।তবুও আমরা ভিতরে যাচ্ছিলাম না। একটু পরে কি মনে করে পারভীন সামান্য দূরের একটা রুমে গেলো , আমি অদূরেই দাঁড়িয়ে ছিলাম । দেখলাম লোকগুলো পারভীনের ব্যাগ হাতরাচ্ছে। আমি দুর থেকে শুনছিলাম , পারভীন বলছে আমার ব্যাগে আর কিছু নাই , আমার আব্বার জন্য কয়েকটা পেয়ারা কিনেছিলাম আর আমার মোবাইল। আমি সাথে সাথে বুঝে গেলাম এবং যারপরনাই জীবন বাজী রেখে দৌড়াতে শুরু করলাম আর চিৎকার করে বললাম, নুরজাহান দৌড়াও, দৌড়াও। আমি কখন মেইন রোডের কাছে এসে পড়েছি জানিনা। দৌড়াচ্ছিলাম আর পিছনে তাকিয়ে দেখছিলাম নুরজাহানকে। এক পর্যায়ে আমি দেখলাম একজন নুরজাহানকে ধরার চেষ্টা করছে, আমি আরো জোরে দৌড় দিলাম। আমি এবার দেখলাম , লোকগুলো নুরজাহানকে ধরে ফেলেছে এবং হাতাহাতি হচছে। আমি নিঃশ্বাস বন্ধ করে দৌড়ে মেইন রোডে উঠলাম। জনশূন্য রাস্তা, দু একজন লোক শুধু গন্তব্যে হেঁটে যাচ্ছে , চোখে মুখে উৎকন্ঠা। শুধু পুলিশ আর পুলিশের গাড়ী । আমি কিচ্ছু চিনছিলাম না। এতোই নার্ভাস ছিলাম যে সবকিছু ভুলে গিয়েছিলাম । দাঁড়িয়ে আছি, ভাবছি কি করবো। তখনই দেখলাম নুরজাহান দৌড়াতে দৌড়াতে আসছে। কাছে আসলে জিজ্ঞেস করলাম কি করলো ওরা? নুরজাহান বললো, ভাবী আমার সোনার চেইনটা গলার থেকে টান মেরে নিয়ে গিয়েছে। একটুপর দেখলাম যুব মহিলা লীগের পারভীন ও আসলো দৌড়িয়ে।জিজ্ঞেস করলাম, কি হলো? পারভীন বললো আমার মোবাইলসহ ব্যাগ নিয়ে গিয়েছে আর আমি দৌড় দিতেই আমার ওড়নাটা টেনে রেখে দিয়েছে। আমরা তিনজন সামনের দিকে হাঁটতে শুরু করলাম। স্বন্ধা হয়ে গিয়েছে। একজন লোককে জিজ্ঞেস করলাম, এটা কোন জায়গা? লোকটি বললেন এটা পুরানা পল্টন। আমি বললাম, ভাই হোটেল প্রীতম কোথায়? উনি বললেন আরো সামনে গেলেই হাতের বাম পাশে পাবেন। আমাদের এক পারিবারিক বন্ধুর বাসা ছিলো ঠি ক প্রীতম হোটেলের পাশেই। এরা হলো চিত্রনায়িকা রোজী সামাদ এর পরিবার। আমরা ঐ বাসায় যেয়ে উঠলাম । রোজী সামাদের ছোট ভাই চিনু ছিলো আমার হাজবেন্ডের ছোটবেলার বন্ধু। এই বাসায় এসে ভাবীর কাছ থেকে পারভীনকে একটা ওড়না নিয়ে দিলাম। বাসায় ফোন করলাম, সব বললাম। সবাই ইতিমধ্যেই ঘটনা জেনেছিলো এজন্য আমার কোন খোঁজ না পেয়ে চিন্তায় ছিলো। একটুপরে টিপুম মুন্শী ভাই, (যিনি তখন গুলশান থানার আওয়ামী লীগের সভাপতি ছিলেন, বর্তমানে বানিজ্য মন্ত্রী ) , গুলশানের এম পি রহমতউল্লাহ ভাই, জসীমভাই, কাদের ভাই, ওয়াকীল ভাই এবং গুলশানের সব নেতৃবৃন্দ খোঁজ নিলেন কারন সবাই জেনেছিলো যে আমি সেই জনসভায় ছিলাম। আমি তখন ছিলাম বৃহত্তর গুলশান থানা মহিলা আওয়ামী লীগের সভানেত্রী। যখন শুনলাম আইভী রহমান এর কথা, ভীষন খারাপ লেগেছিলো। সেই দুর্বিসহ ২১ শে আগষ্টের কথা মনে পড়লে আজও অন্তরাত্বা কেঁপে উঠে।
আইভী রহমান এবং সেদিন যারা গ্রেনেড হামলার শীকার হয়ে জীবন দিয়েছেন, আমি তাদের বিদেহী আত্মার শান্তি কামনা করছি। মহান আল্লাহ তাদেরকে জান্নাতবাসী করুন।
এরকম ঘৃণিত ঘটনা যেন আর কখনো না ঘটে।এটাই আল্লাহর দরবারে প্রার্থনা।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

- Advertisment -

সর্বাধিক জনপ্রিয়

সাম্প্রতিক মন্তব্য