
মোঃ রফিকুল ইসলাম
আজকাল আমাদের দেশে দেখবেন ভালো মানুষরা বিছিন্ন। ভালো মানুষের মধ্যে যোগাযোগ নেই, তারা একা, তারা তো আলাদা ঘরে একা একী শুয়ে থাকেন, পরস্পরকে খুঁজে পান না। কিন্তু যারা খারাপ তারা খুবই সংগবদ্ধ। তারা সয়তান হাতের তুরি দিলে মুহুর্তের মধ্যে হাজার হাজার সয়তান জড় হয়ে যায়। তাই না? সেই জন্য আজকে আমাদের দেশে দুর্বৃত্তরা ভালো মানুষদের চাইতে অনেক উপরে উঠে গেছে। তাদের চোখের পর্দা থাকে না, মুখের সীমানা থাকে না। যখন তখন মনে যা কিছু আসে তা-ই করে ফেলতে দ্বিধাবোধ করে না। গুনিজনদেরকে সম্মান দিতে চায় না। এমনকি পিতা-মাতাকেও নয়। তাদেরকে মরন নেশায় পেয়ে গিয়েছে।
আজ তারা অনেক শক্তিশালী হয়েছে। আমাদের সংগ্রাম তো তাদের সাথেই, তাই না! আমরা চাকুরীজীবি, পেশাজীবি, অনেকেই শিক্ষক, অনেকেই শ্রমজীবি, আমি নিজেও একজন চাকুরীজীবি। আমি নিজেই প্রাথমিক অবস্থায় বেকারত্ব দূরীকরণে ঢাকার শহরে ৫-৭ বছর শিক্ষকতা করেছি। এই যে, একটা শক্তিশালী অন্ধকার। এই অন্ধকারের সঙ্গে যদি আমরা যুদ্ধ করতে হয় এবং এই যুদ্ধে যদি আমাদের জয়ী হতে হয়, তাহলে আমাদের কী করতে হবে। আমাদের আলোকে যোদ্ধা তৈরী করতে হবে। যে যোদ্ধারা অন্ধকারের পক্ষে হবেন, না কি আলোর পক্ষে হবেন? নিশ্চয়ই আলোর পক্ষে হবেন। সেই যোদ্ধাদের আজ আমাদের গড়ে তুলতে হবে। কারণ ছোট মানুষ আর বড় জাতি এটা একসঙ্গে কখনো হয় না। যদি জাতি হিসাবে আমাদের বড় হতে হয় তাহলে মানুষ হিসাবেও আমাদের বড় হতে হবে।
ইসলামী স্বর্ণযুগের সময় আবু রায়হান আল-বিরুনি একজন ইরানী পন্ডিত এবং পলিম্যাথ ছিলেন। তিনি এক অসাধারণ কথা বলেছিলেন। তাঁর ভারত তথ্য বইতে লিখেছিলেন কোন শহরের মানুষের আচার-আচরণ বুঝবেন ঐ শহরের রাস্তা-ঘাট দেখে। যদি রাস্তা ছোট হয় তাহলে বুঝবেন ঐ শহরের মানুষের মন ছোট আর রাস্তা বড় হলে বুঝবেন ঐ শহরের মানুষের মন বড় এবং জাতি হিসাবে তারা সুসংগর্ঠিত এবং সংঘবদ্ধ।
একটা দেশ ও জাতির মধ্যে নান ধরণের মানুষের বসবাস। কেউ শিক্ষক, কেউ ডাক্তার, কেউ ইঞ্জিনিয়ার, কেউ কন্ট্রাকটর, কেউ আমলা, কেউ ব্যবসায়ি, কেউ কামার-কুমার, জেলে আরো কতো কিছু আছেন। আমাদের মনে রাখতে হবে আমরা যে যেই পেশাই থাকি না কেন আমাদের সকলকে একটা যায়গায় আসতেই হয়। সেই যায়গায়টার নাম কি? সেটা হলো বিদ্যালয়। আমরা একটা সময় বাচ্চা ছেলে-মেয়ে ছিলাম, চেহারা দেখে মনে হতো কিছুই না। অথচ আজ আমরা অনেকেই বড় বড় পদবী নিয়ে চাকুরী করছি, ব্যবসা করছি। কিন্তু সেদিন কি কেউ বলতে পেরেছি আমরা এত বড় বড় পদে অধিষ্ঠিত হবো। সমাজে বুক ফুলিয়ে মাথা উচিয়ে দাঁড়াতে পারবো। আমাদের এই বিদ্যালয় থেকে প্রেসিডেন্ট, প্রধানমন্ত্রী, মন্ত্রি, এমপি হতে পারে এমনকি নোবেল বিজয়ীও হতে পারে, হতে পারে একদিন বিশ্বের শ্রেষ্ঠ মানুষ। আজ সেটা হয়তো কল্পনায় কিন্তু বাস্তবে হতেও পারে, তাই না? কবির ভাষায় বলেত হয়: ঘুমিয়ে আছে শিশুর পিতা সব শিশুরই অন্তরে। আমরা কেউ জানি না, কেন-ই-বা আমরা বিদ্যালয় যাই? কি-ই-বা আমাদের ভবিষ্যৎ। আমরা কি জন্য যাই? খারপ হওয়ার জন্য, না কি ভালো হওয়ার জন্য? সুতরাং আমাদের দায়িত্ব কী?
শিক্ষাগুরুরা মানুষ গড়ার কারিগর। ছোট ছোট কোমলমতি ছেলে-মেয়েদের ভালো পথে নেওয়ার জন্য তাদের মননে শুদ্ধ করা, তাদের স্বারকে শক্তিশালী করা, তাদেরকে যোগ্য মানুষ হিসাবে গড়ে তোলা এটাই হচ্ছে একজন শিক্ষকের কাজ বা দায়িত্ব।
শিক্ষকের প্রধান দায়িত্ব হলো: জাতিকে বড় করে তোলা, শিক্ষক যদি বড় হয়, জাতি বড় হবে। শিক্ষক যদি ছোট হয় জাতি ছোট হবে। আমরা যে যেখানে যেই পেশায়ই অবস্থান করছি না কেন সেখান থেকেই জাতিকে বড় করতে হবে, সমৃদ্ধ করতে হবে, শক্তিশালী করতে হবে। একজন মা যেমন তাঁর সন্তানকে নিঃস্বার্থভাবে ভালো বেসে তিলে তিলে গড়ে তুলেন, ঠিক তেমনিভাবে আমাদেরকে গড়ে তুলতে হবে। একত্রিত হতে হবে, প্রতবন্ধকতাকে প্রতিহত করতে হবে। সমাজ থেকে আগাছা, ধুলিকণা দূর করতে হবে। দূর করতে কালোবাজারী, রাহাজানি, নিষিদ্ধকৃত বস্তুসমূহ এবং ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে বড় করে তুলতে হবে। আমাদের ভাবতে হবে কীভাবে একটা শিশু বড় হয়? মনে রাখতে ভালো কিছু বা বড় কিছুর সংস্পর্শে আনলে মানুষ বড় হয়, এখন যদি, আমি বলি আমি সুন্দর হতে চাই, কি হলে আমি সুন্দর হবো? আমি বলবো সুন্দরের কাছাকাছি যেতে হবে। সুন্দরের স্পর্শেই আস্তে আস্তে সুন্দর হয়ে যাবে। চাঁদের সাথে বাস করবো, ফুলের সাথে বাস করবো, জোসৎনার সাথে বাস করবো, কবিতার সাথে বাস করবো, সঙ্গীতে সাথে বাস করবো, সুন্দর প্রকৃতির মধ্যে ঘুরে বোড়াবো, দেখবেন আস্তে আস্তে মন সুন্দর হয়ে যাবে। মন খারাপ হলে হলে যেতে হবে সমুদ্রের তীরে দেখবেন মন ভালো হয়ে যাবে। কোন কিছু দেখার সখ হলে চলে যাবেন ভ্রমণে দেখবেন মন ভালো হয়ে যাবে।
মনে রাখবেন আমাদের এই ছোট মনটাকে সুন্দর প্রফুল্ল রাখতে সুন্দরের কাছেই যেতে হবে। জ্ঞান অর্জন করতে হলে অবশ্যই বেশী বেশী বই পড়তে হবে। প্রেম করতে চাইলে, প্রকৃতি সম্পর্কে জানতে চাইলে প্রকৃতির গাছের সাথে প্রেম করতে হবে। দেখুন আপনি ছোট একটা চারা রোপন করলেন, সকাল বিকাল পরিচর্যা করুন। দেখবেন দিনে দিনে রূপ পরিবর্তন হতে চলেছে। একদিন ঐ গাছে ফুল, ফল ধারণ করতে চলেছে। তখনি আপনার মনে আনন্দ জেগে উঠবে। এবং আপনার কাজের পরিধিও বেড়ে যাবে। মনে রাখতে হবে “আপনি একটি পাইন গাছ হতে না পরলেও নর্দমায় ব্যাঙের ছাতা হবেন না, তবে সমতলে গোলাপে পরিনত হন” জীবনটাকে জীবনের মতো গড়ে তুলতে হবে। কারো প্রতি ইর্শানিত হয়ে নয় বরং গঠনমুলক প্রতিযোগিতায় এগিয়ে যেতে হবে।
আমরা যদি বড় হতে চাই, শিক্ষাগুরুর কাছে যেতে হবে। শিক্ষা গ্রহণ করতে হবে। আমাদের সন্তানদেরকে নিয়মিত বিদ্যালয় পাঠিয়ে দিতে হবে। আমার এক চাচা বলেছিলেন বিদ্যালয়ে পড়া হউক বা না হউক নিয়মিত বিদ্যালয় যেতেই হবে, পড়া হউক বা না হউক পড়ার টেবিলে বসতেই হবে। যে ছাত্র ভালো সে কিন্তু অধিকাংশ সময় পড়ার টেবিলে বসে কিছু না কিছু পড়ছে। এবাভেই তার অগ্রগতি। জ্ঞানের চাইতেও পৃথিবীতে বড় জিনিস আছে, সেটা হলো বড় মনের হৃদয়। যেখান থেকে জ্ঞানের জন্ম, যেখান থেকে জ্ঞান সম্প্রারিত হয়, সেই হৃদয়ের চেয়ে আর বড় কিছু নাই। মানুষের হৃদয় কা’বার চেয়েও সুন্দর এবং পবিত্র। হঠাৎ বলে উঠবেন এ-কি কথা, শুনে আসছি পৃথিবীর সবচেয়ে পবিত্র জায়গা কা’বা, সেই কা’বার চাইতে আবার পবিত্র কি হতে পারে? হ্যাঁ নিশ্চয়ই আমাদের হৃদয়, এটাই সত্য। মনে রাখতে হবে এই ক’বা যিনি বানিয়েছিলেন তিনিই পৃথিবীর সমগ্র মুসলিম জাতির পিতা। তিনি হলেন হযরত ইব্রাহীম খলিল, আর তাঁর হৃদয় যিনি বানিয়েছিলেন তিনি হলে স্বয়ং মহান আল্লাহ। তিনিই আমাদের মহান সৃষ্টি কর্তা, পালন কর্তা। এখন চিন্তা করে দেখুন কোনটা বড়? নিশ্চয়ই আমাদের হৃদয়। দেখুন ঈমান না থাকিলে যেমন মুসলিম হওয়া যায় না, তেমনি বড় মাপের হৃদয় না থাকলে বড় হওয়া যায় না। আমরা মুসলিমরা পাঁচটি জিনিসের উপর মনে প্রাণে বিশ্বাস স্থাপন করতে হবে। যেমন: (১) কালিমা-মুখে বলতে হবে লা-ইলাহা ইল্লেল্লাহু মুহাম্মদুর রাসুল্লাহ এবং হৃদয় ধারণ করতে হবে। (২) নামাজ: দৈনিক পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ আদায় করতে হবে। (৩) আমরা মুসলিমরা পবিত্র রমজান মাসে ত্রিশ দিন সিয়াম সাধনায় ব্রতি থাকি। (৪) যাকাত: যাদের টাকা পয়সা এবং সম্পদের মালিক তারাই যাকাত প্রদান করতে হবে। এবং (৫) টাকা হলে পবিত্র হজ্জ পালন করতে।
মহান আল্লাহ-তায়ালা আঠারো হাজার মাকলুকাত সৃষ্টি করেছেন। তাঁর এই সৃষ্টি জগতের মধ্যে আমরা মানব জাতিই সর্বশ্রেষ্ঠ জাতি। শুধুমাত্র মানব কল্যাণেই বাকী সতেরো হাজার নয়শত নিরানব্বইটি। কিন্তু তাঁর মধ্যেই শ্রেনী-ভেদ রয়েছে। আমরা সবাই বড় হওয়ার চেষ্টা করি, লেখা-লেখি করি, সবাই কী বড় হতে পারি, সবার হৃদয় কী এক, সবার লেখা কী পত্রিকায় প্রকাশ পায়, নিশ্চয় নয়। তবে আমরা বড় হতে না পারলেও সুন্দর মনের মানুষ হতে পরি, সুন্দর হৃদয়ের মানুষ হতে পারি সমাজকে পরিচ্ছন্ন করতে পারি, সমাজকে আলোকিত করতে পারি। যেহেতু আমাদের ঐশ্বর্য্য, সৌন্দর্য, মেধা, আলো ইত্যাদি রয়েছে। তদুপরি কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, জাতিয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম আরো অনেক মনিসি ও গুনিজন মৃত্যুবরণ করেছেন কিন্তু তাঁরা আজও আমাদের মাঝে বেঁচে আছেন এবং থাকবেন তাঁদের সৃষ্টির মধ্য দিয়ে। সুতরাং মানুষের সবচেয়ে বড় জিনিস হলো মানুষের মেধা, মানুষের হৃদয়।
পরিশেষে, আমরা আমাদের ছেলে-মেয়েদেরকে বড় করতে চাই, কিন্তু কি ভাবে? তাদেরকে শিক্ষা দান করতে হবে। বিদ্যালয় পাঠাতে হবে। সুশিক্ষায় শিক্ষিত করতে হবে। তাদের জীবন কোরআন, হাদিসের আলোকে আলকিত করতে হবে। আবার পশ্চিমা বিশ্বের সাথে তাল মিলিয়ে ইংরেজী শিক্ষায় শিক্ষিত করতে হবে। কারণ বর্হিবিশ্বে লেন-দেন করতে হলে অবশ্যই ইংরেজী ভাষা শিখাতে হবে। মহান আল্লাহ-তায়ালা পবিত্র কোরআনুল কারিমে ঘোষণা করেছেন তাঁর(আল্লাহর) কাছে কোন ভাষা নেই, কোন দিক নেই সবই আল্লাহর সৃষ্টি। তিনি (আল্লাহ) এটাও বলেছেন ঐ সময় মক্কায় অর্থাৎ আরবরা ছিল অন্দকারে এবং বরবর জাতি। তাদেরকে বুঝানোর জন্য আরবী ভাষায় পবিত্র কোরআন জানিল করেছেন যাতে আরবরা সহজে বুঝতে পারে। আমাদের মেধা, জ্ঞান আলোর সৌন্দর্য্য সব কিছুতেই মহান আল্লাহ রহমত রয়েছেন। অতএব বেশী বেশী বই পড়া, কোরআন পড়া, হাদিস পড়া তবেই আমাদের জীবন সুন্দরভাবে প্রতিষ্ঠত হবে। যিনি মহত হবেন তাঁর জ্ঞান, মনন, মস্তিস্ক সবকিছুতেই বড় হৃদয় এবং সুন্দর মন ধারণ করবে।