Monday, June 23, 2025
Homeমন্তব্যলম্বা চুলের বেনী আমার

লম্বা চুলের বেনী আমার

খা‌লেদা বাহার

খুব ছোটবেলা থেকেই আমি লম্বা চুল ভীষণ পছন্দ করি।যখন প্রাইমারী স্কুলে পড়তাম তখন একই ক্যাম্পাসের উল্টোদিকে অবস্থিত গার্লস হাই স্কুলের আপুদের দিকে মুগ্ধ নয়নে তাকিয়ে থাকতাম। কবে বড় হবো, কবে হাইস্কুলে পড়বো?এই স্বপ্ন আমাকে সবসময় তাড়া করে ফিরতো। পরিপাটি লম্বা বিনুনী, দুইদিকে পড়ে দোল খাওয়া দোপাট্রা,চলনে বলনে কেমন বড় বড় ভাব, কেমন ঢং ঢাং! আমি দূর থেকে শুধু দেখতাম আর স্বপ্ন বুনতাম। বিশেষ করে যেদিন ম্যাট্রিক পরিক্ষার্থীদের বিদায় অনুষ্ঠান হতো যাকে “Fare well” বলা হতো, সেদিনতো ফাটাফাটি অবস্থা! সেদিন যেন ওরা আরো অনেক বড় হয়ে যেতো, অন্যরকম সুন্দর লাগতো সেদিন।

গ্রামের স্কুলের ম্যাট্রিক -এ পড়া মেয়েদেরকে সবাই অনেক বড়ই ভাবতো।কপালে কুমকুমের টিপ্, দুইগালে ব্লাশন(রুজ), কাজল পড়া চোখ, লিপস্টিক মাখা গোলাপী ঠোঁট,সেই লম্বা বেনী, মা, বড় বোন বা ভাবীদের থেকে ধার করা শাড়ি পড়ে একেবারে পটের বিবি হয়ে আসতো!আমার চোখে যেন এখনও লেগে আছে সেই সুন্দর রুপ!চোখ জুড়িয়ে যেতো। যখন মানচিত্রের সেই গৎবাঁধা সংলাপ পড়া হতো,”যেতে নাহি দিবো,তবু চলে যেতে হয়,তবু চলে যায়!” এই লাইনগুলো পড়লেই দেখতাম ওদের সেই কাজল চোখগুলো ছল ছল করে উঠতো।এটাই ছিলো ফেয়ার ওয়েলের শ্বাশত চিত্র। আমার তখন আব্বার উপর মনে মনে রাগ হতো কারন চুল একটু লম্বা হলেই ‘বসন্ত ‘নামক এক নাপিতের ক্ষুর, কাঁচি চালানো হতো।সবসময় আমার এবং আমার বড় বোনের মেয়ে নীলু( আমরা প্রায় সমবয়সী ছিলাম)র চুল ছিলো ঘাঁড়ের অনেক উপরে। আব্বার মতবাদ ছিলো ছোট মেয়েদের লম্বা চুল থাকলে পাকা পাকা লাগে তাই এই ববড কাটিং, যেন গলা ছিলা মুরগী!
পুতুল খেলার নেশা ছিলো আমার আর নীলুর। বাজারে যেয়ে খলিফার দোকানে ঘুরে ঘুরে বিভিন্ন ছাপার টুকরো কাপড় সংগ্রহ করা ছিলো আমার নিত্য দিনের কাজ।আমার পুতুলগুলোর চুল ছিলো লম্বা।নববিবাহিত ভাবীদের টারসেল( গুছি) চুরি করে সেখান থেকে কালো রেশমী সুতার গোঁছা কেটে তবেই হতো আমার পুতুলের লম্বা চুল।নতুন বউ বলে মনে মনে বিরক্ত হলেও তাঁরা কিছু বলতো না। প্রাইমারী শেষে হাইস্কুলে উঠলাম, কলেজ পার করে বিশ্ববিদ্যালয়ে আসলাম , চুল লম্বা করার স্বপ্ন অধরাই থেকে গেলো।

রোকেয়া হলে যখন থাকছিলাম তখন কত আপু, দিদিদের সেই সুবীর নন্দীর গানের কলির মতো “ঐ কালো কেশ তুমি ছড়ালে যখন , মেঘেরাও পেলো যেন লজ্জা”এমনই লম্বা চুল দেখে মুগ্ধ হয়েছি! মৌসুমী দি ছিলেন এরকম চুলের অধিকারী। হাঁটুর নীচ্ অবধি সাপের মতো দোল খেতো বিনুনী।
যেন ‘নাটোরের বনলতা সেন’। আমার চুল সেই তথৈবচ!কিন্তু শখ করে শাড়ি পড়লে টারসেল দিয়ে চেষ্টা করতাম লম্বা বেনী করতে।বিশ্ব বিদ্যালয়ের আন্তঃহল নাট্য প্রতিযোগিতায় রোকেয়া হল থেকে মণ্চস্থ হওয়া রবীন্দ্র নাথের “চিরকুমার সভা”য় নৃপবালা চরিত্রে অভিনয়ের সময় আমার কস্টিউম ছিলো বেগুনী পাড়ের মাস্টার্ড কালারের শাড়ি এবং গলায়, হাতে রাবিন্দ্রিক স্টাইলের কুচি দেওয়া ব্লাউজ সাথে সেই লম্বা চুলের বেনী।অপূর্ব ছিলো সেই কস্টিউম। নাটকটি দ্বিতীয় স্থান লাভ করেছিলো।যথারীতি মাস্টার্স শেষ করে আমি হাজবেন্ডের সাথে ইংল্যান্ডে পাড়ি জমাই। লন্ডন যাওয়ার সময় আমি একটা টারসেল নিতে ভুলিনি। একদিন কেন্ট নামক জায়গায় আমাদের এক আত্বিয়ের বাসায় বেড়াতে যাবো, সাথে ছিলো আমার বিশ্ববিদ্যালয়ের বান্ধবী মিশু।আমি সেই টারসেল দিয়ে একটা লম্বা বেনী করলাম! খুব মুড নিয়ে যাচ্ছি, লম্বা চুলের বেনী আমার! আমরা যখন লন্ডন ব্রীজ স্টেশানে বাস বদলানোর জন্য তাড়াহুড়া করে হাঁটছিলাম হঠাৎ চোখে পড়লো একজন পুলিশ আমাদের দিকে এগিয়ে আসছে।আমি একটু ভড়কে গেলাম, কি হলো আবার! কিছুটা কাছে আসতেই খেয়াল করলাম, তাঁর হাতে কালো একটা কিছু। একদম কাছে এসেই পুলিশ ভদ্রলোক মুচকী হেসে আমাকে বললেন, “Excuse me, this is your long hair’একটু অপ্রস্তুত হয়ে গেলাম এবংপিছন দিকে চুলে হাত বাড়িয়ে বুঝলামআমার শখের লম্বা বেনী উধাও!

সংগৃহীত

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

- Advertisment -

সর্বাধিক জনপ্রিয়

সাম্প্রতিক মন্তব্য