সালেহ রনকঃ
‘পরপুরুষের ছোঁয়া লাগবে’ —এই ধর্মীয় বিধিনিষেধ ভূমিকম্পে আটকা পড়া নারীদের জন্য মৃত্যুর পরোয়ানা হয়ে এসেছে! হ্যাঁ ঠিকই শুনছেন, মন ভেঙে দেওয়ার এই খবরটি আফগানিস্তানের। তালেবানের শরিয়া আইনে ‘পরপুরুষের ছোঁয়া হারাম’ – এই নীতির কঠোর প্রয়োগের ফলে উদ্ধারকারী পুরুষরা ধ্বংসস্তূপে চাপা পড়া নারীদের উদ্ধার করতে অসম্মতি জানাচ্ছেন।
তালেবান সরকারের গোঁড়া ধর্মীয় নিয়মে, কোনও নারীকে কেবলমাত্র তাঁর বাবা, ভাই, স্বামী বা ছেলেই স্পর্শ করতে পারবেন। এই নিষেধাজ্ঞা এমন জরুরি অবস্থাতেও শিথিল করা হয়নি, যার ফলে উদ্ধারকর্মীরা নারীদের স্পর্শ করতে ভয় পাচ্ছেন। কারণ এতে তাদের ধর্মীয় ও সামাজিক শাস্তির আশঙ্কা রয়েছে। অনেক ক্ষেত্রে মৃত নারীদের পোশাক ধরে টেনে হিঁচড়ে বের করা হচ্ছে দেহ, যাতে ত্বকের স্পর্শ না হয়! কী করুণ দৃশ্য!
এমন অবস্থা কেন হলো, নারী উদ্ধারকর্মীরাইবা কোথায়?
তালেবান শাসনে নারীদের কর্মক্ষেত্রে অংশগ্রহণ এক প্রকার নিষিদ্ধ। ২০২১ সালে তালেবান দ্বিতীয় দফায় ক্ষমতায় আসার পর থেকে নারীদের অধিকার ক্রমাগত সীমিত হতে থাকে। ষষ্ঠ শ্রেণীর পর মেয়েদের শিক্ষা বন্ধ, পুরুষ অভিভাবক ছাড়া ভ্রমণ নিষিদ্ধ, এবং কর্মক্ষেত্রে নারীদের অংশগ্রহণ নাই বললেই চলে। এর ধারাবাহিকতায় যা হবার তাই হলো: উদ্ধারকারী দলে নারী সদস্যের তীব্র অভাব স্পষ্ট হয়ে উঠল। নারী চিকিৎসকের চরম সংকটের কারণে আহত নারীরা চিকিৎসা পাচ্ছেন না। এছাড়াও তালেবান সরকার মহিলা চিকিৎসকদেরও পরপুরুষের সামনে উদ্ধারকাজে অংশ নিতেও অনুমতি দেয়নি।

অথচ ইসলামে জীবন রক্ষার ওপর বিশেষ গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। ‘জীবন বাঁচানো ফরজ’–এ বিষয়ে সরাসরি কোরআনে উল্লেখ না থাকলেও, ‘তোমরা নিজেরা নিজেদের সর্বনাশ করো না’ (সূরা বাকারাহ: ১৯৫) এই আয়াত থেকে ইসলামিক ফেকাহবিদরা এই সিদ্ধান্তে পৌঁছেছেন যে, জীবন বাঁচানো একটি ফরজ কাজ। অর্থাৎ, জীবন সংশয়ে পড়লে হারাম বা নিষিদ্ধ খাবারও গ্রহণ করা বৈধ হতে পারে, যদি তা জীবন রক্ষার জন্য অত্যন্ত জরুরি হয়। শুধু নিজের জীবন নয়, অন্যের জীবন রক্ষা করাও ইসলামের একটি গুরুত্বপূর্ণ কাজ। কোন ব্যক্তি যদি একটি জীবন রক্ষা করে, তবে সে যেন সমগ্র মানবজাতিকে রক্ষা করল (সূরা মায়েদা: ৩২)।
কিন্তু তালেবানরা নিজের ধর্মও ঠিকঠাক মানে না । তারা দেশ চালাচ্ছে নিজেদের ফতোয়ায়। নিজেদের রাজনৈতিক এজেন্ডা বাস্তবায়নের জন্য ইসলামকে করছে ব্যবহার।
আফগানিস্তান। নামটি শুনলেই আজ চোখের সামনে ভেসে ওঠে ধূসর মরুভূমি, যুদ্ধবিধ্বস্ত শহর আর বোরখায় আবৃত নারীদের ছবি। কিন্তু এই দেশটি এক সময় এমন ছিল না, একেবারেই না।
১৯৯০-এর দশকের আফগানিস্তান ছিল শিক্ষা, সংস্কৃতি ও প্রগতিতে পরিপূর্ণ একটি রাষ্ট্র। কাবুল বিশ্ববিদ্যালয় তখন সৃজনশীলতা ও জ্ঞানচর্চার প্রাণকেন্দ্র ছিল। রাস্তায়-ঘাটে, ক্যাফেতে, পার্কে মেয়েরা স্বাচ্ছন্দ্যে চলাফেরা করত। তাদের পরনে থাকত জিন্স, টি-শার্ট বা স্কার্ট; কেউ কেউ স্বেচ্ছায় হিজাব পরতেন, তাও সংখ্যায় ছিল নগণ্য। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে শুরু করে সরকারি-বেসরকারি সকল কর্মক্ষেত্রে নারীদের সক্রিয় ও গর্বিত অংশগ্রহণ ছিল চোখে পড়ার মতো। তারা ছিলেন ডাক্তার, শিক্ষিকা, শিল্পী, প্রকৌশলী—রাষ্ট্র গঠনের অগ্রযাত্রার বড় অংশ।
কিন্তু একটি দেশ তার মোট জনসংখ্যার অর্ধেককে, তার নারীশক্তিকে, অবরুদ্ধ রেখে কতটুকুইবা আগাতে পারে? নারীমুক্তি ছাড়া যে জাতীয় মুক্তি অর্থহীন। নারী ছাড়া একটি রাষ্ট্রকে কখনোই পূর্ণাঙ্গ, হিতকর ও মানবিক করে তোলা যায় না। দুর্ভাগ্যবশত, আফগানিস্তানেই তার করুণ প্রমাণ মিলল। কট্টরপন্থী তালেবানরা ধর্মের নামে, একটি বিকৃত ও কঠোর ব্যাখ্যার আড়ালে, দেশটির সমস্ত প্রগতি, সংস্কৃতি ও স্বাধীনতাকে পিষে দিলো। তারা নারীদের অদৃশ্য করে দিয়ে একটি প্রতিশ্রুতিশীল দেশকে অন্ধকারেই নিমজ্জিত করল। আজ আফগানিস্তানের যে চিত্র আমরা দেখি, তা সেই উজ্জ্বল অতীতেরই একটি করুণ ইতিহাস।
ধর্মান্ধতা তাদের দৃষ্টিকে এমনভাবে মুছে দিলো যে তারা ভুলে গেল–ধ্বংসস্তূপে আটকা একজন নারী প্রথমে একজন মানুষ, তারপর তার ধর্ম বা লিঙ্গ। ধর্মীয় গোঁড়ামির কারণে একজন মানুষকে বাঁচানো থেকে বিরত থাকা শুধু নারীর অমর্যাদা নয়, বরং মানুষের মর্যাদাকে তাচ্ছিল্য করা।
আমাদের দেশেও যখন দেখি একদল ধর্মান্ধ গোষ্ঠী শরিয়া আইনের নামে একটি কঠোর ও অনমনীয় বিধি-বিধানের জন্য আওয়াজ তুলছে, তখন সত্যিই ভয় তৈরি হয়। আরও আতঙ্কিত হই যখন দেখি, এই আওয়াজের সাথে সায় দিয়ে তাকে সমর্থন জানায় উল্লেখযোগ্য সংখ্যক নারী। এই দৃশ্য অত্যন্ত বিভ্রান্তিকর ও হতাশাজনক।
ইতিহাস সাক্ষী, আফগানিস্তানেও শুরুটা হয়েছিল ঠিক এভাবেই। একটি ‘পবিত্র’ ও ‘নৈতিক’ সমাজ গঠনের লোভনীয় প্রতিশ্রুতির আড়ালে ধর্মের নামে চাপিয়ে দেওয়া হয়েছিল একের পর এক বিধিনিষেধ। তারপর ধীরে ধীরে লতার মতো বিধিনিষেধের পর্দা পুরো দেশটাকে, তার স্বপ্নগুলোকে, তার সম্ভাবনাকে গিলে ফেলল।
আজ আফগানিস্তানে যা হচ্ছে, নারীরা যে মানবেতর, কারাবন্দীর জীবন যাপন করছে—শিক্ষা, কাজ, বিনোদন থেকে সম্পূর্ণরূপে বিচ্ছিন্ন—তা স্পষ্টভাবে দেখার পরও কি এদেশের শরিয়া আইন চাওয়া নারীদের বোধদয় হচ্ছে না? নাকি ধর্মান্ধতা তাদের দৃষ্টিশক্তিকে এতটাই দুর্বল করে দিয়েছে যে, ইতিমধ্যেই তারা স্বেচ্ছায় দাসত্ব বরণ করতে নিজেদের প্রস্তুত করে ফেলেছেন?
ধর্ম মানুষ জন্য, মানুষ ধর্মের জন্য নয় – যখন ধর্মের নামে মানুষের জীবন বিপন্ন হয়, তখন ধর্ম আর ধর্ম থাকে না, হয়ে ওঠে রাজনৈতিক অস্ত্র। শুধু শরিয়া আইনের বেলায় নয়, আমাদের ভাবনাচিন্তা, আমাদের সচেতনতা আরও বাড়ানো উচিত, সমাজে আরও বেশি বেশি প্রশ্ন তোলা উচিত — ইতিহাস থেকে কতটুকু শিখলাম আমরা?
লেখাটি লেখকের একান্ত ব্যক্তিগত।