Friday, July 11, 2025
Homeমন্তব্যপরকীয়া মানেই ব্যভিচার, অশান্তি, বিচ্ছেদ

পরকীয়া মানেই ব্যভিচার, অশান্তি, বিচ্ছেদ

মোঃ রফিকুল ইসলাম

আমাদের মাঝে দিন দিন শিক্ষার আলো ছড়াচ্ছে, মানুষ দিন দিন উন্নতির শিখরে অধিষ্ঠিত হচ্ছে। জ্ঞান-বিজ্ঞানে এগুচ্ছে। মানুষ আজ পৃথিবী জয় করে মঙ্গলে গিয়ে ঘাটি বানাচ্ছে। দুঃখের বিষয় হলো যতই জ্ঞান বিজ্ঞানে এগুচ্ছে মানুষের মধ্যে ততই অধ:পতন লক্ষ্য করা যাচ্ছে। মহান আল্লাহ আমাদের জ্ঞান-বুদ্ধি দিয়ে ভালো-মন্দ বিচার বিশ্লেষণ করার অনুভূতি দিয়েছন। অথচ আমরা জেনেশুনেও বিষ পান করছি। আমরা একজনের সংসার বিনষ্ট করে পরকীয়ার মতো ব্যভিচার বেহায়পনা করছি।

পবিত্র কোরআনুল কারিমের সুরা নূরের ৩০ নম্বর আয়াতে আল্লাহ তায়ালা পুরুষদের দৃষ্টি সংযত রাখার নির্দেশ দিয়েছেন। এরপর ৩১ নম্বর আয়াতে নারীদের দৃষ্টি সংযত রাখার পাশাপাশি পরপুরুষের সামনে তাদের সৌন্দর্য প্রকাশ করতে নিষেধ করেছেন। স্ত্রীর সৌন্দর্য একমাত্র স্বামীর কাছে উন্মুক্ত করে দিলে স্বামী খুশি হন আবার সংসারেও শান্তি আসে। পক্ষান্তরে নারীর সৌন্দর্য তার স্বামী ছাড়া অন্য কাউকে আকর্ষণ করলে তা কেবল অশান্তিই বাড়বে।

ইসলামে পরকীয়া ও অবৈধ সম্পর্ক থেকে নারী-পুরুষকে কঠোরভাবে সতর্ক করা হয়েছে। একান্ত প্রয়োজন ছাড়া কোনো নারীর পরপুরুষের সঙ্গে কথা বলা উচিত নয়। “সূরা আহ-জাবের ৩২ নম্বর আয়াতে আল্লাহ তায়ালা নারীদের পরপুরুষের সঙ্গে কোমল ও আকর্ষণীয় ভঙ্গিতে কথা বলতে নিষেধ করেছেন”। যাতে নারীদের সঙ্গে কথা বলতে গিয়ে কোনো পুরুষ আকর্ষণবোধ না করেন। যদিও এ আয়াতটি নবীর স্ত্রীদের উদ্দেশ্য করে নাজিল হয়েছিল, তবে তা সব মুমিনের বেলায় প্রযোজ্য।

সূরা বনি ইসরাইলে আল্লাহ পুরুষ-নারী সবাইকে চরিত্র সংরক্ষণের নির্দেশ দিয়েছেন। আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘তোমরা ব্যভিচারের নিকটবর্তী হয়ো না। এটা অশ্লীল কাজ এবং নিকৃষ্ট আচরণ। ‘ (সূরা বনি ইসরাইল, ৩২)

সূরা নূরে ব্যভিচারের শাস্তি উল্লেখ করতে গিয়ে আল্লাহ বলেন, ‘ব্যভিচারী ও ব্যভিচারিণী উভয়কে একশ ঘা করে বেত্রাঘাত কর। ’ (সূরা নূর, ২)

রাসুলুলুল্লাহ (সা.) ব্যভিচারের ভয়ানক শাস্তির কথা বর্ণনা করেছেন। তিনি বলেন, ‘হে মুসলমানরা! তোমরা ব্যভিচার পরিত্যাগ কর। কেননা এর ছয়টি শাস্তি রয়েছে। এর মধ্যে তিনটি দুনিয়াতে ও তিনটি আখেরাতে প্রকাশ পাবে। যে তিনটি শাস্তি দুনিয়াতে হয় তা হচ্ছে, তার চেহারার ঔজ্জ্বল্য বিনষ্ট হয়ে যাবে, তার আয়ুষ্কাল সংকীর্ণ হয়ে যাবে এবং তার দারিদ্র্য চিরস্থায়ী হবে। আর যে তিনটি শাস্তি আখেরাতে প্রকাশ পাবে তা হচ্ছে, সে আল্লাহর অসন্তোষ, কঠিন হিসাব ও জাহান্নামের শাস্তি ভোগ করবে। ‘ (বায়হাকি, হা নম্বর-৫৬৪)

স্ত্রীদের তাদের দেবরের সঙ্গে দেখা-সাক্ষাৎ করার ক্ষেত্রেও সাবধনতার বিধান রেখেছে। হজরত উকবা ইবনে আমের (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘সাবধান! তোমরা নির্জনে নারীদের কাছেও যেও না। ’ এক আনসার সাহাবি বললেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ! দেবর সম্পর্কে আপনার নির্দেশ কী? নবীজি (সা.) বললেন, ‘দেবর তো মৃত্যুর সমতুল্য। ’ (মুসলিম, ২৪৪৫)

সুতরাং বুঝতেই পারছেন ইসলাম সর্বক্ষেত্রে পরকীয়ার মতো ব্যভিচার থেকে বিরত থাকতে বলেছে। এর বিপরীতে কঠিন শস্তির বিধান রেখেছে। আল্লাহ আমাদের জৈবিক চাহিদা, স্বাভাবিক প্রবৃত্তি আর শয়তানের প্রলোভন সব বিষয়ে অবগত। তাই তার দেওয়া বিধানের পরিপূর্ণ অনুসরণ আমাদের জীবনকে করবে সহজ ও সাবলীল। আসুন আমরা সেই চেষ্টা করে যাই। আল্লাহ আমাদের সবার পারিবারিক জীবনকে হেফাজত করুক।

একটি প্রবাদে আছে সংসার সুখের হয় রমনীর গুনে। সেই প্রাচীন বাক্যটি আজও বিদ্যমান কারণ এই যুগে অনেকে অনেক কিছু পরিবর্তন করেছে কিন্তু সেই পুরানো বাক্যটি আজও একইভাবে রয়ে গেছে।

যে ধর্মেরই হই না কেন প্রত্যেক ধর্মের মধ্যেই বিবাহ বন্ধন রয়েছে। এই বিবাহ বন্ধনটিই আমাদের সততা, আমাদের বিশ্বাস, আমাদের শ্রদ্ধাবোধ ও আমাদের ভালোবাসা। আর এই ভালোবাসা না থাকলে আমাদের পারিবারিক বন্ধন বিনষ্ট হয়ে যায়। আমাদের সংসার টেকানো যায় না। আর বিশ্বাস অবিশ্বাসে সংসার টেকানো যায় না। পারিবারিক বন্ধন অটুট রাখতে হলে একে অপরের উপর শত ভাগ বিশ্বাস রাখতে হবে। তবেই আমাদের জীবনমান আমাদের পারিবারিক বন্ধন ভালো থাকবে।

স্বামী স্ত্রীর মধ্যে সন্দেহ বিভাজন জিইয়ে রেখে সংসার করা ঠিক নয়। কারণ একে অপরের প্রতি পাহাড় সমঅভিযোগ তৈরী করে সংসারে আরো আগুন বৃদ্ধি পায়।  কেন না আগুন যখন জ্বালানো হয় তখন আস্তে জ্বলে যখন প্রখর আকার ধারণ করে তখন আগুনের কাছে যাওয়া যায় না। তদ্রুপ স্বামী স্ত্রীর মধ্যে সন্দেহ বিভাজন সৃষ্টি হলে এটা ধীরে ধীরে বড় আকার ধারণ করে তখন খুন খারাবী সংগঠিত হয়। সেক্ষেত্রে উভয়ের সম্মত্তিতে বিচ্ছেদ ঘটানোই শ্রেয়।

আমাদের মনে রাখতে হবে স্বামী বা স্ত্রী থাকা সত্বেও যদি অন্যের সঙ্গে শারেরীক সম্পর্ক গড়ে তোলে সেটা কোন মানুষই ঠান্ডা মাথায় মেনে নেবে না। শয়তানের বা অন্যের প্ররোচনায় সুখ খুঁজতে গিয়ে হয়তো দেখা যাবে নিজের সংসারই শেষ হয়ে গিয়েছে।

তাই আমাদের উচিৎ সংসারে ঝগড়া বা কলহ সৃষ্টি না করে সরে যাওয়াই ভালো। যেহেতু পবিত্র কোরআনুল কারিমে সুরা তালাক নামক একটি সুরা নাজিল করা হয়েছে। সেক্ষেত্রে পরস্পর পরস্পরের সহিত বনিবনা না হলে বিচ্ছেদ হওয়া ভালো।

মনে রাখতে হবে যার সঙ্গে সংসার করেছেন কোন না কোন কারণে তাকে আপনার ভালো না লাগতে পারে। নিজেদের মধ্যে বনিবনা না হলে বা স্বামী বা স্ত্রী পরস্পর সমঝোতা না হলে ইসলামে তালাকের ব্যবস্থা রয়েছে। সেক্ষেত্রে আপনি তালাক দিতে পারেন। মনে রাখতে হবে জীবন আপনার। সিদ্ধান্ত আপনার। চলার পথে আনন্দ বেদনার পথ বেছে নেয়ার দায়িত্বও আপনার।

অপরাধীকে নয় অপরাধকে ঘৃণা করুন। তাহলেই অপরাধ প্রবণতা কমে যাবে। পরকীয়া অতি পরিচিত একটি শব্দ। এই শব্দটি একটি সুন্দর গোছালো সংসার ভেঙ্গে টুকরা টুকরা করে ফেলে, ভবিষ্যৎ নষ্ট করে, পারিবারিক ও সামাজিক মূল্যবোধের ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধক “পরকীয়া” শব্দটি।

অথচ বর্তমানে পরকীয়া প্রকট আকার ধারণ করেছে। একই বিছানায় সুয়ে নারী পুরুষ পরকীয়া করছে। এই অশালিন ঘৃর্ণিত কাজটি শহর গ্রাম সর্বত্রই ছরিয়ে ছিটিয়ে পড়েছে। কে বুড়ো কে যুবক যুবতী তার বাদ বিচার করে না। সবাই আবেগের তারণায় রঙিন চশমা পড়ে এই গর্হিত ঘৃর্ণিত অপকর্মটি করে যাচ্ছে। অসৎ চরিত্রের মানুষ শয়তানের প্ররোচনায় স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে একটা বিভেদ সৃষ্টি করে। আবার আর্থিক দৈন্যতায় পরকীয়া করেছেন অনেকে। আবার গর্হিত কাজ করতে গিয়ে কোন কোন সময় নিজ স্ত্রীর দ্বারা স্মামী খুন হয়। পক্ষান্তরে নিজ স্বামীর দ্বারা স্ত্রীও খুন হয়।

বর্তমান প্রেক্ষাপটে এটা উৎপত্তি হয় বাচ্ছাকে স্কুলে আনা নেয়া করতে গিয়ে মহিলারা মহিলাদের মধ্যে পরিচয় ঘটে। এই পরিচয় অনেক সময় হিতে বিপত্তিও ঘটে। এছাড়া সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে একে অপরের সাথে পরিচয় হয় এবং নেটে চ্যাটিং করতে করতে এমন একটা সময় আসে তারা অন্তরঙ্গ হয়ে পড়ে। ফলে তাদের সুখের সংসারে ফাটল ধরে। সংসার ভেঙ্গে যায়। আবার খুন খারাবীও ঘটে।

এই সকল ঘটনা খুবই দুঃখজনক। স্বামী বর্তমান থাকা সত্বেও অন্যে সঙ্গে অনৈতিক সম্পর্কে জড়িয়ে যাওয়া। এই গর্হিত কাজ কোন মানুষই মেনে নিবে না বা মেনে নেয় না। এই পরকীয়া করতে করতে একসময় সন্তান সুখের সংসার ছেড়ে অনত্র চলে যায়। ফলে কেউ সুখি হয় আবার কেউ রাস্তায় নেমে আসে। যেটাকে আমরা প্রেম ছেকা বলে থাকি। একইভাবে স্বামীও পরকীয়ায় আসক্ত হয়ে স্ত্রীর অধিকার থেকে বঞ্চিত করে কেউ কেউ স্ত্রীকে তালাকের মতো গর্হিত কাজ করতেও দ্বিধাবোধ করে না। বর্তমান সমাজে এই পরকীয় আসক্ত হয়ে দিন দিন ডিভোর্সের সংখ্যা ভেড়ে যাচ্ছে। আল্লাহ সবাইকে হেদায়েত করুক।

একথা সত্য সংসারে বিশ্বাসই হলো সুখের মুল। স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে বিশ্বাস, শ্রদ্ধাবোধ ও ভালোবাসা না থাকলে সংসার করা যায়না। স্বামী থাকা সত্বেও পরকীয়া করা লুকোচুরি করা এক ধরনের প্রতারণা। পক্ষান্তরে স্ত্রী থাকা সত্বেও পরস্ত্রীর সাথে পরকীয় করা এক ধরনের প্রতারণা। এই অনৈতিক অবৈধ প্রেম পিরিতি ভালোবাসা খুঁজতে গিয়ে হয়তো একদিন দেখবেন নিজের পায়ের তলার মাটি হারিয়ে ফেলেছেন।

শয়তানের প্ররোচনায় অন্যকে ভালো লেগেছে এটা মনের থেকে দূর করে সঙ্গীর সঙ্গে মানিয়ে নিতে হবে। সম্ভব না হলে পারিবারিক এবং পরস্পর সমঝোতার ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত নিতে হবে।

পরিশেষে, আমাদের মনে রাখতে হবে জীবনের লক্ষ্যে পৌঁছাতে হলে আনন্দ বেদনার মধ্যেই একে অপরকে নিরন্তর ভালোবাসা দিয়ে সুখের সংসার গড়ে তুলতে হবে। সুন্দর সুখি জীবন তুলতে হলে একে অপরের প্রতি ছাড় দিতে হবে। বিয়ে একদিনের জন্য নয় বিয়ে এমন একটা বন্ধন এটা নিয়ে লুকোচুরি করা যাবে না। একে অপরের জীবন সঙ্গি হিসেবেই জীবন যৌবন কাটাতে হবে। সংসার পরিচালনায় একে অপরের সাথে পরামর্শ করতে হবে। তবেই জীবন তথা সংসার সুখের হবে। সবার জন্য বয়ে আনুক অনাবিল আনন্দ, সুখ, শান্তি, শৃংখলা সেই কামনা সবার জন্য।

লেখকঃ মোঃ রফিকুল ইসলাম, একান্ত সচিব, সিইও এবং চেয়ারপারসন, ইসলামী কমার্শিয়াল ইন্স্যুরেন্স কোঃ লিঃ, প্রধান কার্যালয়, ঢাকা।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

- Advertisment -

সর্বাধিক জনপ্রিয়

সাম্প্রতিক মন্তব্য