Monday, June 23, 2025
Homeশীর্ষ সংবাদদিহানদের সৃষ্টিতে পারিবারিক দায় এড়াবেন কিভাবে?

দিহানদের সৃষ্টিতে পারিবারিক দায় এড়াবেন কিভাবে?

শাহীন কামাল :

রাজধানীতে মাস্টারমাইন্ড স্কুলের শিক্ষার্থী আনুশকা নিহতের ঘটনা ও এ বর্বরোচিত কর্ম পরবর্তি নানা বিষয় বিচার বিশ্লেষণ, নিহতের পরিবারের দাবি ও অপরাধীর স্বীকারোক্তিতে  এখন পর্যন্ত দোষী উচ্চবিত্ত পরিবারের বখে যাওয়া সন্তান দিহান৷ এক একটা ঘটনা পরবর্তীতে এ সঙ্গে সম্পর্কিত নানা বিষয়ে আলোচনা-সমালোচনা হয়, অপরাধীর অপরাধ সংক্রান্ত পূর্বাবস্থা বিশ্লেষণ, সম্ভাব্য কারণ, সম্পৃক্ততা নিয়ে চুল-ছেঁড়া বিচার বিশ্লেষণ করি আমরা নিজস্ব দৃষ্টিকোণ থেকে। তথ্য প্রযুক্তির অবাধ সুযোগ আর অনেকগুলো ইলেকট্রনিক মিডিয়ার কারণে ঘটনা বিষয়ক খুটিনাটি আমাদের দৃষ্টি এড়ায় না। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমও এখানে জোড়ালো ভুমিকা রাখে। মাঝেমধ্যে অবশ্য মিডিয়া ট্রায়াল কিংবা সোসাল জাজমেন্টের অতিরঞ্জিত আচরণ বিচার ব্যবস্থাকে প্রশ্নবিদ্ধ করে। দিহানের পারিবারিক জীবনযাপন নিয়ে কথা উঠেছে। আলোচনা এসেছে প্যারেন্টিং বিষয়েও।

কোন এক দুর্ঘটনা পরবর্তীতে আলোচনা সমালোচনা দোষের নয় বরং তা ক্ষেত্রবিশেষে অনেক কার্যকর। আনুশকা হত্যার বিচার তথা অপরাধীর শাস্তি সমাজ কিংবা রাষ্ট্রকে যতখানি সন্তুষ্টি দিতে পারবে, অপরাধীর এই নোংরা পথে আনয়নে যেই মাধ্যমগুলো সামান্য হলেও দায়ী রয়েছে সেই সকল বিষয়গুলোকে সম্মুখে এনে উন্মোচন করতে পারলে তারচেয়ে বেশী লাভবান হবে সমাজ। আনুশকা হত্যার দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হলে ভবিষ্যতে অপরাধী অপরাধ করতে দ্বিতীয়বার ভাববে। মনে রাখতে হবে, অপরাধীর বিচারই শেষ কথা নয়, অপরাধের পথও বন্ধ করতে হবে। দিহান কেন, কিভাবে এতবড় অপরাধী হয়েছে সে বিষয়গুলো আলোচনায় এনে ভবিষ্যতে দিহানরা যেন এহেন অপকর্মে সুযোগ না পায় সেই পন্থাও রুদ্ধ করে দিতে হবে সমাজকেই। তা না হলে, অন্য কোন আনুশকার নির্মম পরিনতিতে আমরা আবার কোন দিহানের শাস্তি দাবী করতে হবে।

ঐশীর কথা মনে আছে? দিহানের সমবয়সী ঐশীর কথা সচেতন ব্যক্তিমাত্রই মনে রাখার কথা। রাজধানীর চামিলীবাগে পুলিশ ইন্সপেক্টর বাবা মাহফুজুর রহমান ও মা সপ্না বেগমের একমাত্র কন্যা ইংরেজি মিডিয়ামের ‘ও’ লেভেলের শিক্ষার্থী ঐশী নিজ হাতে ছুড়ি দিয়ে বাবা মাকে হত্যা করে। ২০১৩ সালের ১৬ আগষ্টের ঘটনা। ধনীর আদরের কন্যা আজ সর্বস্ব হারানোর পরে কারাগারের অন্ধকার রুমে যাবৎজীবন কাটাচ্ছে অতীত অনুশোচনায়। ফাঁসির দণ্ডপ্রাপ্ত হলেও বয়সের কারণে দয়াপরবশত আদালত তার শাস্তি কমিয়েছে। ঐশী ছুড়ি দিয়ে বাবামাকে হত্যা করেছিল আর দিহানের নোংরামিতে শুধু আনুশকাই নিঃশেষ হয়নি তার নিজের বাবামাকেও লজ্জা, ঘৃণার ছুড়িতে খণ্ডবিখণ্ড করেছে। গণমাধ্যমে দিহানের মায়ের পাঠানো বিবৃতিতে নানা কথা হয়েছে সত্য কিন্তু একজন মায়ের কাছে এ ঘটনা অবশ্যই লজ্জার৷ অর্থনৈতিক সামর্থ্য থাকা স্বত্তেও সে তার সন্তানের জন্য আইনজীবী নিয়োগ করেননি কিংবা করতে পারেননি।

দিহান ঐশীর মতোই অর্থবিত্তের বলয়ে বড় হয়েছিল। বাবা মায়ের অঢেল বিত্তবৈভবে তার কিশোর মনকে মানুষ হতে দেয়নি। এ বয়সেই দামী গাড়ি আর বিলাসবহুল জীবন তাকে অমানুষ হিসাবে গড়েছে যেমনটি হয়েছিল ঐশীর ক্ষেত্রে। স্কুলপড়ুয়া কিশোরী ঐশীর সাপ্তাহিক হাত খরচ ছিল দশ হাজার টাকা। আশ্চর্য হলেও সত্য যে তার বাবা মা তাকে প্রথমদিকে সেই টাকার যোগান দিয়েছেন। তার খরচের মাত্রা কিন্তু একদিনেই এত উচ্চস্তরে পৌঁছেনি। প্রথমদিকে বাবামা মেয়ের চাহিদা অনুযায়ী অর্থ যোগান দিয়ে পিতামাতার মহান দায়িত্ব পালনে সচেষ্ট ছিলেন। নিজেদের যেকোনো উপায়ে উপার্জিত অর্থ সন্তানের উপর ঢেলে দেয়া কোন ভালো প্যারেন্টিং নয়, তা তারা বেমালুম ভুলে গিয়েছিলেন। অঢেল অর্থও যে সন্তানের অনর্থ ঘটাতে পারে তা যখন বুজেছেন তখন অনেক দেরি হয়েছিল আর তার মূল্য দিতে হয়েছিল প্রাণ দিয়ে।

ঘটনার দিন আনুশকা তার বন্ধুর বাসায় যাবে বলে মাকে বলে বাসা থেকে বের হয়েছিল। হ্যাঁ, দিহানই ছিল সেই বন্ধু। অথচ আনুশকার মা জানতেই পারেননি কিংবা জানার প্রয়োজনবোধ করেননি কে সেই বন্ধু? কোথায় সে থাকে অথবা তাদের পরিচয়ইবা কিভাবে? ঐশী তার বাবা মাকে হত্যা করার পূর্বে বন্ধু রনির সাথে পরামর্শ করেছিল এবং হত্যাকাণ্ড ঘটিয়ে রনির কাছে আশ্রয় নিয়েছিল। একটা সময় ছিল যখন সন্তানের বন্ধুবান্ধবদের বিষয়েও স্বচ্চ ধারণা রাখতেন আমাদের বাবামায়েরা। সন্তান কার সাথে মিশে, কোথায় সময় কাটায়, বাসা থেকে কত টাকা নিয়ে বের হয়, এবং সেই টাকার পরিমাণ প্রয়োজনোতিরিক্ত কিনা সে বিষয়ে দৃষ্টি রাখতেন অভিভাবকরা। অথচ আজ ব্যক্তিস্বাধীনতার নামে সন্তানদের ছেড়ে দিয়ে ক্ষেত্রবিশেষে দিহান কিংবা ঐশী হওয়ার পথ সুগম করে দিচ্ছেন অতিধনী জনগোষ্ঠী পিতামাতাদের কেউ কেউ।

দিহান আনুশকার সাথে যে পৈশাচিক কর্মকাণ্ডে লিপ্ত হয়েছিল তা কোন স্বাভাবিক মানুষের পক্ষে সম্ভব নয়। শক্তিশালী কোন মাদকদ্রব্য কিংবা অন্যকোন কারণ না হলে প্রায় সমবয়সী মেয়েটার এহেন মৃত্যু হওয়ার কথা নয়। দিহানের মধ্যে এই দানবের জম্ম একদিনে হয়নি। ধীরে ধীরে তার মধ্যে লালিত দানবটা বড় হতে হতে এ পর্যায়ে পৌঁছেছে, আর সেই দানবকে বড় হতে প্রয়োজনীয় আলোবাতাস সরবরাহ করেছে তার চারপাশ। এত কিছুর পরও যদি মেয়েটা বেঁচে যেত তবে আমাদের এই দানবরূপী দিহানকে দেখতে হতো না। অর্থাৎ এমন অনেক দিহানের বাস রয়েছে সমাজে যারা লোকচক্ষুর অন্তরালে রয়ে গেছে।

আনুশকা হত্যাকাণ্ডের দিনকয়েক আগে এমনই আরেকটি লোমহর্ষক ঘটনা ঘটেছে দেশে। ২১ ডিসেম্বর ১৭ বছরের এক কিশোরকে হত্যা করে তার বাবা মা আর বোন মিলে৷ অত্যন্ত সচেতনতার সাথে  হত্যা করে লাশ লুকিয়ে রাখে পার্শ্ববর্তী ডোবায়। মাদকাসক্ত এ কিশোর অপরাধী নিজ বোনের সাথে অপকর্মে লিপ্ত হতে চেয়েছিল। মানষিক বিকৃত আর মানবিকতার কত অধঃপতন হয়েছে আমাদের সমাজে!

বয়ঃসন্ধিকালের সময়টা অনেক ঝুকিপূর্ণ হিসেবেই বিশেষজ্ঞমহলের কাছে বিবেচিত হয়ে আসছে। এ সময়টি যেমন একজন ছেলে কিংবা মেয়ের ভবিষ্যৎ গঠনের জন্য যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ তেমনিভাবে বয়সটায় লাইনচ্যুত হওয়ারও ভয় থাকে যথেষ্ট৷ এ সময়টাকে অত্যন্ত দায়িত্বের সাথে হ্যান্ডেল করতে হয়। কিন্তু দুঃখ আর হতাশাজনক যে, এ সময়টাতে সন্তানকে অত্যাধিক স্বাধীনতার নামে তাদের সকল ইচ্ছা আর প্রাপ্তির প্রত্যাশাকে পূরণ করতে কিছুকিছু বাবা মা উঠেপড়ে লাগেন। সন্তানের কিছুকিছু চাওয়াকে না বলতেও শিখতে হবে বাবা মাকে। মনে রাখতে হবে লাগামহীন স্বাধীনতা কখনো কখনো দুর্যোগ বয়ে আনে। অতি আধুনিকতা আর লাগামহীন অর্থনৈতিক স্বাবলম্বী সন্তানকে সুপথে পরিচালিত করার পরিবর্তে তাদের জীবনে আমাবস্যার অন্ধকার নিয়ে আসতে পারে আর তা রোধ করার সকল পথই বন্ধ হয়ে যায় তখন। 

কিশোর গ্যাং নিয়ে ইদানীং কথা হচ্ছে। নানাবিধ অপরাধে জড়াচ্ছে কিশোর কিশোরী। এই সকল অপরাধীদের একটা সাধারণ মিল রয়েছে যে এরা সকলেই মাদকাসক্ত। মাদকের সহজলভ্যতা, অর্থনৈতিক স্বাবলম্বী আর পিতামাতার উদাসীনতাই এই সকল অপরাধী সৃষ্টির মূল। ফলে সুন্দর সমাজ বিনির্মানে এই বিষয়গুলো নিয়ে ভাবতে হবে। রাষ্ট্রের কড়া আইন অপরাধীকে বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়ে দিতে পারে, কিন্তু অপরাধ বন্ধে এগিয়ে আসতে হবে পরিবারকে। সমাজ কিংবা রাষ্ট্রের জন্য কঠিন হলেও পারিবারিক শৃঙ্খলা অপরাধী সৃষ্টি বন্ধে কার্যকর ভুমিকা রাখতে পারে এবং আমাদের সকলের প্রয়োজনে পরিবারকে সেই দায়িত্ব নিতে হবে।

সন্তানের জন্য উত্তম শিক্ষালয় হতে হবে পরিবারকে। পিতামাতার গভীর ভালোবাসা আর প্রয়োজনীয় শাসন আর নিয়মের বেড়াজালে বন্দী রাখতে হবে সন্তানকে। পরিবারকে সময় অসময়ে বিচারালয় হতে হবে,  হতে হবে কারাগারও। পিতামাতার যথেচ্ছা অর্থনৈতিক সুবিধা সরবরাহের ক্ষেত্রেও হিসেবি হতে হবে। স্বাধীনতার লাগাম কৌশলে টেনে রাখতে হবে, তবে তা করতে হবে শুরুতেই। পারিবারিক শৃঙ্খলা, শিক্ষা, শাসন, বিচার ব্যবস্থা চালু থাকলে সমাজে অনেক বড় বড় অনাচার থেকে মুক্তি পাবে। তা না হলে পরিবারকেও বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড় করাতে হবে। দিহানের এহেন অপকর্মের পরে সামাজিক কাঠামোর মূল ভিত্তি পরিবার তথা অভিভাবকত্ব দায় এড়াতে পারে না।

লেখকঃ শিক্ষক, সাংবাদিক

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

- Advertisment -

সর্বাধিক জনপ্রিয়

সাম্প্রতিক মন্তব্য