বিশ্বব্যাপী কিডনি রোগ একটি ভয়াবহ স্বাস্থ্য সমস্যা, কিডনি রোগের ব্যাপক প্রকোপ, এ রোগের মারাত্মক পরিণতি, অতিরিক্ত চিকিৎসার খরচ এবং চিকিৎসা ব্যয় সাধ্যাতীত হওয়ায় সিংহভাগ রোগী প্রায় বিনা চিকিৎসায় মৃত্যুর করুন চিত্র তুলে ধরেন গতকাল স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন ক্যাম্পস আয়োজিত ‘‘কিডনি সুরক্ষায় জ্ঞানের বিস্তার অপরিহার্য’’ শীর্ষক গোল টেবিল বৈঠকে আলোচক বৃন্দ। বক্তাগণ সরকারী/বেসরকারী ও স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা কিংবা প্রতিষ্ঠান গুলোর সমন্বিত ও পরিকল্পিত প্রয়াসের প্রতি গুরুত্ব আরোপ করেন।
বক্তারা বলেন, ধনী-গরীব কিংবা সুবিধা বঞ্চিত শ্রেণী নির্বিশেষে দেশের প্রত্যন্ত এলাকার সর্বস্তরের কিডনি রোগীদের চিকিৎসা প্রাপ্তির অধিকার নিশ্চিত করণের অঙ্গীকার এবং বাস্তবায়নের সর্বাত্মক প্রচেষ্টা নিতে হবে।
‘‘বিশ্ব কিডনি দিবস ২০২২’’ উদযাপন উপলক্ষ্যে আয়োজিত কর্মসূচীর অংশ হিসেবে দেশের শীর্ষস্থানীয় কিডনি বিষয়ক বেসরকারী স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা কিডনি এওয়ারনেস মনিটরিং এন্ড প্রিভেনশন সোসাইটি (ক্যাম্পস), ০৫ মার্চ (শনিবার) দৈনিক প্রথম আলো সম্মেলন কক্ষে এক গোল টেবিল বৈঠকের আয়োজন করে।
গোল টেবিল বৈঠকে প্রধান অতিথি মাননীয় স্বাস্থ্য মন্ত্রী তার ভিডিও বার্তায় জানান, কিডনি রোগের প্রকোপ ব্যাপক, চিকিৎসা ব্যয় অত্যন্ত বেশী। তবে এই রোগ প্রতিরোধ যোগ্য। এই লক্ষ্যে সারাদেশের মানুষদের মধ্যে গণসচেতনতা গড়ে তোলার উপর গুরুত্ব আরোপ করেন। বিগত প্রায় দেড় যুগ যাবৎ কিডনি রোগ প্রতিরোধে গণসচেতনতা বৃদ্ধি করতে ক্যাম্পস এর গুরুত্ব পূর্ণ ভূমিকার প্রশংসা করেন এবং বিত্তবানদের এমন মহৎ কাজে সহযোগীতার আহবান জানান। বিত্তহীন কিডনি বিকল রোগীদের চিকিৎসা নিশ্চিত করতে ক্যাম্পস প্রস্তাবিত ‘‘কিডনি সুরক্ষা বীমা’’ বাস্তবায়িত করার প্রত্যয় ব্যাক্ত করেন।
গোল টেবিল বৈঠকে প্যানেল আলোচক হিসেবে উপস্থিত ছিলেন অধ্যাপক ডাঃ মোঃ শারফুদ্দিন আহমেদ, ভাইস-চ্যান্সেলর, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়। কাজী আকরাম উদ্দিন আহমেদ, চেয়ারম্যান, স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংক লিমিটেড, ইন্টারন্যাশনাল ডিরেক্টর, লায়ন্স ক্লাব ইন্টা: ও সাবেক সভাপতি, এফবিসিসিআই। স্থপতি ইকবাল হাবিব, যুগ্ম সম্পাদক, বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন-বাপা ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক, ভিত্তি স্থপতি বৃন্দ লিমিটেড। মোঃ আনিসুল হক, সহযোগী সম্পাদক, প্রথম আলো ও সাহিত্যিক। অধ্যাপক ডাঃ হারুন উর রশিদ, সভাপতি, কিডনি ফাউন্ডেশন। অধ্যাপক ডাঃ এম এ সালাম, সাবেক সভাপতি, বাংলাদেশ এসোসিয়েশন অব ইউরোলজি। অধ্যাপক ডাঃ মোঃ রোবেদ আমিন, লাইন ডাইরেক্টর, নন কমিউনিকেবল ডিজিজ কন্ট্রোল (এনসিডিসি), স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। অধ্যাপক ডাঃ মোঃ আব্দুল হালিম, অধ্যক্ষ, কুমুদিনী উইমেন্স মেডিকেল কলেজ। অধ্যাপক ডাঃ এ কে এম ফজলুর রহমান, নির্বাহী পরিচালক, সেন্টার ফর ইনজুরি প্রিভেনশন এন্ড রিসার্চ বাংলাদেশ। গাজী আশরাফ হোসেন লিপু, সাবেক অধিনায়ক, বাংলাদেশ জাতীয় ক্রিকেট দল প্রমুখ।
ক্যাম্পস এর প্রতিষ্ঠাতা ও সভাপতি এবং আনোয়ার খান মডার্ণ মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল এর অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান অধ্যাপক ডাঃ এম এ সামাদ মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন।
স্বাস্থ্য মন্ত্রী জনাব জাহিদ মালেক, তার বিশেষ ভিডিও বার্তায় বলেন, বাংলাদেশে ২ কোটিরও অধিক লোক কিডনি রোগে আক্রান্ত। দিন দিন কিডনি রোগের হার বাড়ছে। দুই যুগ আগে মৃত্যুর কারণ হিসেবে ছিল ২৭তম অবস্থানে, ২০৪০ সাল নাগাদ তা এগিয়ে আসবে ৫ম অবস্থানে। কিডনি বিকলের একমাত্র চিকিৎসা ডায়ালাইসিস অথবা কিডনি সংযোজন যা এত ব্যয়বহুল যে এদেশের শতকরা ১০ ভাগ লোকও এই ব্যয়বহুল চিকিৎসা চালিয়ে যেতে পারেনা। পক্ষান্তরে সুস্থ জীবন ধারা চর্চা ও কিডনি রোগের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ লোকদের নিয়মিত কিডনি স্ক্রিনিং এর মাধ্যমে ৫০ থেকে ৬০ ভাগ ক্ষেত্রে এ রোগ প্রতিরোধ করা সম্ভব। পরিশেষে তিনি দেশবাসীর উদ্দেশ্যে বলেন, কিডনি রোগ জীবন নাশা, প্রতিরোধই বাঁচার আশা।
অধ্যাপক ডাঃ মোঃ শারফুদ্দিন আহমেদ বলেন, কিডনি রোগ বৃদ্ধির কারণ খতিয়ে দেখতে হবে এবং এর চিকিৎসা ব্যয় কমানো সম্ভব হচ্ছে না কেন সেটা বিশ্লেষণ করে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নিতে হবে।
তিনি আরো বলেন, কিডনি রোগ প্রতিরোধে সচেতনতা বাড়াতে স্কুল কলেজের পাঠ্যপুস্তকে বিষয়টিকে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। তিনি সুষম খাদ্যাভ্যাস তৈরি ও জীবনাচার গঠনে পারিবারিক ও নৈতিক শিক্ষার উপর গুরুত্বারোপ করেন। তিনি ক্যাম্পস এর স্বেচ্ছাসেবী উদ্যোগসমূহের প্রশংসা করে এ কাজে পৃষ্ঠপোষকদের এগিয়ে আসার আহবান জানান।
কাজী আকরাম উদ্দিন আহমেদ বলেন, কিডনি রোগ চিকিৎসার ব্যয় এত বেশী যে, বিত্তবানদের জন্যও তা চালিয়ে যাওয়া কষ্টকর। যেহেতু এই রোগ প্রতিরোধ যোগ্য তাই প্রতিরোধের উপরেই বেশী গুরুত্ব দিতে হবে। এ জন্য সরকারকেই মূখ্য বা নেতৃত্বের ভূমিকায় অবতীর্ণ হতে হবে।
অধ্যাপক ডাঃ হারুন উর রশিদ বলেন, কিডনি রোগ নির্ণয়, প্রতিরোধ ও চিকিৎসা ব্যয় কমানোর ক্ষেত্রে গবেষণার উপর গুরুত্ব দিতে হবে। তিনি বলেন, অধ্যাপক ডাঃ এম এ সামাদ যে ভাবে শক্ত হাতে ক্যাম্পস কে ধরে রেখেছেন এবং অব্যাহত ভাবে কিডনি রোগ প্রতিরোধের বার্তা ছড়িয়ে দিচ্ছেন এতে সফলতা অবশ্যম্ভাবী।
অধ্যাপক ডাঃ মোঃ রোবেদ আমিন বলেন, কিডনি রোগ প্রতিরোধে সর্বাত্মক প্রচেষ্টা নিতে হবে। এ জন্য একটি সুষ্ঠু কর্মপরিকল্পনা প্রণয়ন করতে হবে। তিনি বলেন, বিশেষ করে বাচ্চাদের এবং যুব সমাজের মাঝে যাতে কিডনি রোগ প্রবেশ করতে না পারে সে জন্য এখনই ব্যবস্থা নিতে হবে। কঠিন ভাবে তাদের ফাষ্টফুড, জাঙ্কফুড, অলসতার প্রবণতা থেকে মুক্ত করতে হবে।
অধ্যাপক ডাঃ এম এ সামাদ তার মূল প্রবন্ধে বলেন, সারা বিশে^ ৮৫ কোটিরও অধিক লোক কিডনি রোগে আক্রান্ত। কিডনি রোগ মহামারি আকারে ব্যাপ্তি লাভ করছে। কিডনি বিকলের চিকিৎসা অত্যন্ত ব্যয়বহুল। তাই সবার জন্য কিডনি সুরক্ষায় জ্ঞানের বিস্তার অপরিহার্য নিশ্চিত করতে প্রতিরোধের উপর বেশি জোর দেওয়া হয়েছে।
তিনি আরো বলেন, সুস্থ জীবন ধারার প্রধান সোপান গুলো হলো অনিয়ন্ত্রিত ডায়াবেটিস ও উচ্চ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে রাখা, নিয়মিত ব্যায়াম ও কায়িক পরিশ্রম করা, পরিমিত স্বাস্থ্যসম্মত বা সুষম খাবার গ্রহণ, ওজন নিয়ন্ত্রণে রাখা, ধূমপান পরিহার করা, পর্যাপ্ত পরিমাণ বিশুদ্ধ পানি পান করা, তীব্র মাত্রার ব্যাথার ঔষধ পরিহার করা। তাছাড়া যারা ঝুঁকিতে আছেন যেমন যাদের ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ, ওজন বেশী, বংশে কিডনি রোগ আছে, যারা ধূমপায়ী, যারা তীব্র মাত্রার ব্যাথার ঔষধ খেয়েছেন, যাদের পূর্বে কোন কিডনি রোগের ঝুঁকি আছে তাদের বছরে অন্তত ২ বার প্র¯্রাব ও রক্তে ক্রিয়েটিনিন পরীক্ষা করে নেয়া উচিৎ। কেননা প্রাথমিক অবস্থায় কিডনি রোগ সনাক্ত করতে পারলে চিকিৎসার মাধ্যমে তা নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব। তিনি কিডনি বিকল রোগীদের চিকিৎসা ব্যয় সাধ্যাতীত হওয়ায় সবার জন্য চিকিৎসা নিশ্চিত করতে ‘‘কিডনি সুরক্ষা বীমা’’ চালু করার জোর সুপারিশ করেন।
ক্যাম্পস এর নির্বাহী পরিচালক রেজওয়ান সালেহীন বলেন, ক্যাম্পস কিডনি রোগ প্রতিরোধের জন্য নিয়মিত সচেতনতার বাণী প্রচার করে যাচ্ছে। আমরা যদি কিছু নিয়ম কানুন মেনে চলি তা হলে কিডনি রোগ প্রতিরোধ করা সম্ভব। তাই সরকারী ও বেসরকারী পর্যায় থেকে যদি সকলে এগিয়ে আসেন তা হলে এই রোগ নিরাময় করা অনেকটাই সহজ হবে। গোল টেবিল বৈঠকে উপস্থিত সকল আলোচকদের তাদের মূল্যবান সময় দেওয়ার জন্য ক্যাম্পস এর পক্ষ থেকে ধন্যবাদ জ্ঞাপন করেন।
এ গোল টেবিল বৈঠকে বক্তারা অভিমত ব্যাক্ত করেন যে, চিকিৎসা করে নয় বরং প্রতিরোধ করেই এ রোগের প্রাদূর্ভাব প্রশমন করতে হবে আর এ জন্য সচেতনতাই একমাত্র উপায়।
এ ছাড়াও গোল টেবিল বৈঠকে দেশের সরকারী পর্যায়ের নীতি নির্ধারক, চিকিৎসক, সাংবাদিক, শিল্পী, শিক্ষাবিদ, ক্রীড়াবিদসহ বরেণ্য ব্যক্তিবর্গ উপস্থিত ছিলেন। প্রেস বিজ্ঞপ্তি