শাহীন কামাল
আরেকটি বছর চলে গেছে কালের গর্ভে। মহাকালের কাছে কোন বিশেষ ঘটনা না হয়ে ক্ষনস্থায়ী মানব জনমের জন্য এক একটা বছর অনেক কিছু। নানাবিধ ঘটনাবহুল ২০২০ সাল মানব ইতিহাসে ভয়ংকর অধ্যায় হিসেবে পরিগনিত হয়ে থাকবে। বিশ্বব্যাপী করোনা মহামারী মানব জীবনের সত্যিকারের মানব রূপ যেমন দেখিয়েছে তেমনি হিংস্রতাও লুকিয়ে রাখতে পারেননি। প্রকৃতির কাছে অসহায় মানবের নিদারুণ হাহাকারও অবলোকন করেছে বিশ্ব।

সংগত কারণেই অনেক উৎসাহ উদ্দীপনাপূর্ণ নববর্ষ শুরু হয়েছিল ২০২০। জাতীয় জীবনে আমাদের নানা অর্জনে চলমান গতিপথ বাঁধা হয়ে স্থবির করে দেয় করোনা মহামারী। মার্চের মাঝামাঝি থেকে আপাতদৃষ্টিতে অচল হয়ে যায় পৃথিবী, আমাদের আবাসস্থল। চেনা জনপদ অচেনা হয়ে যায়। রাস্তাঘাট, দোকানপাট, কর্মস্থলের পরিবর্তে গৃহাভ্যন্তরে বন্দী হয়ে পড়ে জীবন ও জীবিকা। জরুরি সেবা খাতে নিয়োজিত ব্যক্তিবর্গ জীবনের ভয় তুচ্ছ করে ঘরের বাইরে যায়, যেতে হয়েছে। পরিবারের লোকজনের কী অসহায়ত্বের মতো প্রিয়জনের ফেরার আকুতি! করোনা চিকিৎসায় নিয়োজিত ডাক্তারকে বাসা ছেড়ে দেয়ার জন্য এলাকায় আন্দোলন হয়েছে। করোনা সন্দেহে মাকে জঙ্গলে ফেলে দিয়েছে সন্তান। লাশ দাফন করার লোকের অভাব দেখা দিয়েছিল। করোনা সন্দেহে পরিবারের কর্মক্ষম উপার্জনক্ষম ব্যক্তিকে আটকে রেখে অভুক্ত মারা হয়েছে। যারা করেছে তারা স্বজন ছিল। লাশ দাফনের পরিবর্তে পুড়িয়ে ফেলার প্রস্তাব করেছে অতি পন্ডিত শ্রেনী। কবরস্থানের জায়গা ছিল না। মসজিদের খাটিয়া ব্যবহার করতে না দেয়ায় প্রিয়জনের লাশ কাঁধে করে কবরে নিয়েছে স্বজন। জানাজা পড়ানোর লোক না পাওয়ায় পুলিশ আমলা জানাজা পড়িয়েছেন। পক্ষান্তরে, জীবনের ঝুঁকি নিয়ে স্বেচ্ছাসেবক তৈরি হয়েছে লাশ দাফনে। ছেলে বাবার মুখাগ্নি না করে পালিয়েছে। সিড়িতে পরে থাকা অসুস্থ লোককে হাসপাতালে নেওয়ার লোক পাওয়া যায়নি যদিও পুরো ভবনের সবাই ছিল আপনজন। লাশ সরাতে স্বেচ্ছাসেবক আসার প্রয়োজন হয়ে পড়েছিল। হাসপাতালে যখন অসুস্থ সন্তানকে নেয়ার স্ট্রেচার পাওয়া যায়নি, বাবার বুক হয়ে উঠেছে স্ট্রেচার। সবাই মুখ ফিরিয়ে নিলেও করোনায় অসুস্থ প্রিয়তমা স্ত্রীর প্রতি স্বামীর সেই স্নেহময়ী চাহনি ইতিহাস হয়ে থাকবে।
স্থবির হয়ে পড়েছিল বিভিন্ন পেশায় নিয়োজিত লোকদের জীবন। রাষ্টের সাথে এগিয়ে এসেছিল মানবিক মানুষ। মানবিকতার চরম দৃষ্টান্ত দেখিয়েছেন কেউ কেউ। অন্যের জন্য জীবনবাজী রেখেছেন অনেকে। বিপরীত চিত্রও কত ভয়াবহ নয়। মানুষের জীবন নিয়ে বেসাতি করেছে স্বার্থপরমহল।
জীবনের তাগিদে পেশা পরিবর্তন করে টিকে থাকার নিরন্তর পথচলা শুরু করতে হয়েছে অনেককে। জীবনের অনেক উথাল পাথাল ঢেউ সামাল দিতে হচ্ছে অনেককে। কর্মহীন হয়ে স্বপ্নের কর্মস্থল ত্যাগ করে গাঁয়ে থিতু হতে হয়েছে। দেশের সকল শিক্ষার্থী আপাত দৃষ্টিতে অশিক্ষার্থী হয়ে বসে আছে আপন গৃহে। মোবাইল ইন্টারনেট তুলে দিবেনা বলে বদ্ধপরিকর পিতামাতার কষ্টের টাকায় কিনে দিতে হয়েছে এন্ডয়েড ফোন। কাজের সাথে সাথে অকাজ কতটুকু হয়েছে তা সময়ে বলে দিবে।
লাশের সারি দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হয়েছে। অনেক বিশিষ্টজনকে হারিয়েছি। স্বজন হারানোদের কান্নার লোনাজলে ভিজেছে পাষাণ মন। এক একটা মৃত্যুতে এলোমেলো হয়ে গেছে পুরো পরিবারের দীর্ঘদিনের লালিত বাসনা।
স্বপ্ন দেখি এই আঁধার কেঁটে গিয়ে সোনালী সকাল হবে। মুক্ত সমাজে স্বাধীন চলাফেরার সাথে অর্থনৈতিক কার্যাবলীতের গতি আসবে। স্বাভাবিক জীবনের মতো আমাদের সন্তানদের পদচারণায় মুখরিত হয়ে উঠবে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। জীবনের ফ্যাকাসে রঙের পরিবর্তে হাসি আনন্দভরা নতুন সকাল হবে।
shaheenkamal1976@gmail