Friday, August 1, 2025
Homeলাইফস্টাইলঅটিজম ওয়েলফেয়ার ফাউন্ডেশন: অটিজম বৈশিষ্ট্য সম্পন্ন শিশুদের স্বপ্নের ঠিকানা

অটিজম ওয়েলফেয়ার ফাউন্ডেশন: অটিজম বৈশিষ্ট্য সম্পন্ন শিশুদের স্বপ্নের ঠিকানা

মোঃ সোয়েব মেজবাহউদ্দিন

সামাজিক ও পারিবারিক অনুষ্ঠানের মাধ্যমে বিয়ের পর প্রত্যেক দম্পত্তি একটা সন্তানের জন্য ব্যকুল থাকে। সন্তান হওয়ার পর তাদের পরিবার আনন্দে পরিপূর্ন হয়ে যায়। বাবা ও মা সেই সন্তানের ভবিষ্যত নিয়ে নানা প্রকার স্বপ্ন দেখতে থাকে। আর যখন একটু বেড়ে উঠার পর সেই সন্তানের মুখে কথা না ফুটে, সন্তানের ভিতর যখন অস্বাভাবিকতা দেখা যায়, তখন বাবা মায়ের আনন্দ হতাশায় পরিনত হয়।

সন্তানকে নিয়ে তখন ছুটতে থাকে এক চিকিৎসক থেকে অন্য চিকিৎসকের কাছে। বিভিন্ন প্রকার পরীক্ষা নিরীক্ষার পর যখন জানতে পারে তার আদরের সন্তান অস্বাভাবিক বা অটিজম রোগে আক্রান্ত, তখন বাবা মায়ের উপর আকাশ ভেঁঙ্গে পড়ার মত অবস্থা। তখন কি করা করা উচিত, কি করলে সন্তান স্বাভাবিক হবে, ইত্যাদি ইত্যাদি চিন্তা ও একরাশ দুঃচিন্তা ও হতাশা গ্রাস করে অভিভাবকদের। অপরদিকে অটিজম আক্রান্ত শিশু ও অভিভাবককে কিছু কিছু আত্মীয় স্বজন এড়িয়ে চলার চেষ্টা করে। বাজে মন্তব্য করে। যার ফলে একদিকে অটিজম আক্রান্ত অভিভাবক তার সন্তানকে নিয়ে মানসিক চাপে পড়ে যায়, অপরদিকে প্রতিবেশী ও কিছু অশিক্ষিত আত্মীয় স্বজনের কটুকথা তাদের মানসিকভাবে দূর্বল করে তোলে। তারা হতাশায় নিমজ্জিত হয়ে পড়ে ।

এসব অটিজম আক্রান্ত অভিভাবকদের একটা নিরাপদ স্বপ্নের ঠিকানা হচ্ছে ঢাকার কেরানীগঞ্জ মডেল থানার শ্যামলাপুর, মধ্যের চরের চার তলা ভবন বিশিষ্ট অটিজম ওয়েলফেয়ার ফাউন্ডেশন। সুন্দরভাবে সাজানো গোছানো ভবনটি অটিজম বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন  শিশুদের আনন্দে ও বিনোদনে বেড়ে উঠা একটা সঠিক ও উন্নতমানের স্বপ্নের ঠিকানা। এখানে রয়েছে অটিজম বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন সন্তানদের জন্য সুপ্রশিক্ষিত শিক্ষকমন্ডলী, দক্ষ আয়া ও কর্মচারী। দুর-দুরান্তের শিশুদের স্কুলে আনা নেওয়ার জন্য রয়েছে পরিবহন ব্যবস্থা। সুপ্রশিক্ষিত শিক্ষকমন্ডলীর আন্তরিক মায়া-মমতায় ও আদরে অটিজম আক্রান্ত শিশুদের উন্নত জীবনে ফিরতে সহায়তা করে। এই প্রতিষ্ঠানে সন্তানকে পাঠিয়ে দিনের একটি বড় অংশ নিশ্চিন্তে থাকেন অভিভাবকগণ।

২০০৪ সালে রাজধানীর মোহাম্মদপুরের আদাবর বায়তুল আমান হাউজিং এর ২ নং রোডের এক ভাড়া বাড়িতে অটিজম ওয়েলফেয়ার ফাউন্ডেশনের যাত্রা শুরু। প্রতিষ্ঠানটির চেয়ারপারসন ডাঃ রওনাক হাফিজের হাত ধরেই প্রতিষ্ঠানটি যাত্রা শুরু হয়।

শিশু রোগ বিশেষজ্ঞ হিসেবে নাম-ডাক শুরু হয়েছিল ডা: রওনাক হাফিজের। ১৯৮৮ সালে মেয়ে মিতির জন্মের পর থেকে তিন বছরের মাথায় সব পাল্টাতে থাকে। ডা: রওনাক হাফিজ আমেরিকায় মেয়ের চিকিৎসার জন্য যান।দেশের বাইরে নিলে চিকিৎসকেরা জানান তাঁর মেয়ে অটিজম বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন শিশু। তারপর নিজের চিকিৎসা পেশা বাদ দিয়ে শুরু করেন অটিজম নিয়ে পড়াশোনা। বিভিন্ন বিষয়ে প্রশিক্ষণ নেন।

তারপর দেশে ফিরে বাস্তবতা অনুধাবন করে গড়ে তোলেন শত মিতির মত শিশুরদের চিকিৎসা, সেবা ও প্রশিক্ষণের প্রতিষ্ঠান। কয়েকজন অভিভাবককে সঙ্গে নিয়ে গড়ে তোলেন অটিজম ওয়েলফেয়ার ফাউন্ডেশন। প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে সঙ্গে বড় হতে থাকে তাঁর মেয়ে মিতিও। এই মিতির জন্ম না হলে হয়তো এ প্রতিষ্ঠানটিরও জন্ম হতো না।

গত ১৫ জুলাই, ২০২৫ মঙ্গলবার সকালে এ ভবনে গিয়ে দেখা যায়, স্কুলের বাস আসার পর শিশুরা নিজে নিজে বাস থেকে নেমে লাইন করে স্কুলে প্রবেশ করছে। বিভিন্ন বয়সী অটিজম বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন শিশুরা প্রশিক্ষিত শিক্ষকদের সাথে গ্রাউন্ড ফ্লোরে শরীর চর্চা করছে। পাশে নিজস্ব রান্না ঘরেই রান্না হচ্ছে। কিছু শিশুরা ক্যাফেটেরিয়ার কাউন্টারে টাকা দিয়ে খাবার কিনে টেবিলে বসে সকালের নাশতা করছে। এখানেই দুপুরের খাবার খাওয়ার মধ্য দিয়ে কখনো একা বা কখনো অন্য বন্ধুদের সঙ্গে বসে খাওয়ার বিষয়টি তারা রপ্ত করছে। ক্যাফেটেরিয়ার ক্যাশ কাউন্টারে বসে টাকা/পয়সার হিসাব মেলাচ্ছিল। তার হিসাবে কোনো গরমিল হয় না। একইভাবে অটিজম বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন শিক্ষার্থীদের মধ্যে কেউ কেউ প্রশিক্ষণের পাশাপাশি অফিসের কাজ করছেন, কেউ কেউ কম্পিউটারে লেখার কাজ করছেন বা ফটোকপি ও ল্যামিনেট করার দায়িত্ব পালন করছেন। একজন কেক বানিয়ে প্রতিষ্ঠানেই বিক্রি করছেন। এভাবে অনেকেই আয় করা শুরু করেছেন। আর যে শিক্ষার্থীরা বাইরের অন্য শিক্ষার্থীদের সঙ্গে স্বাভাবিক কারিকুলামে পড়াশোনা করছে তাদের জন্যও আছে বিশেষ ব্যবস্থা। অটিজম শিশুদের চিকিৎসা সেবা দেওয়ার জন্য রয়েছে অভিজ্ঞ চিকিৎসক।

বর্তমানে অটিজম ওয়েলফেয়ার ফাউন্ডেশনে দুই শিফটে শিক্ষার্থীর সংখ্যা ১৫০ জন। শিক্ষক, কর্মকর্তা ও কর্মচারী আছেন ৮৪ জন। অভিভাবকদের মধ্য থেকে তিনজন মা এ প্রতিষ্ঠানেই শিক্ষকতা করছেন। তবে ভবনটিতে কিছুক্ষণ থাকার পরও বোঝা গেল না, এই তিন মায়ের সন্তান কারা। কেননা এই মা ও শিক্ষকদের কাছে সব সন্তান সমান।

বয়স বা শারীরিক গঠন নয়, মানসিক বিকাশ অনুযায়ী তাদের জন্য আছে ব্যায়াম, খেলাধুলা বা পড়া, কারিগরি প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা। নাচ, গানে মেতে আছে তারা। ফাউন্ডেশনের শিক্ষার্থীদের স্কুল বাসে শিক্ষকদের তত্ত্বাবধানেই স্কুলে পাঠানোরও সুযোগ পান অভিভাবকেরা। লাইব্রেরি, কম্পিউটার ল্যাব, মাল্টিপারপাস হলের কাজসহ কিছু কাজ প্রায় শেষের পথে। এগুলো হয়ে গেলে অভিভাবকেরা আরেকটু নিশ্চিন্ত হতে পারবেন।

ডা: রওনাক হাফিজ এসব অসমাপ্ত কাজ শেষ করতে সমাজের বিত্তবানদের এগিয়ে আসার জন্য আহবান জানান। ডা: রওনাক হাফিজ বলেন, ‘বাবা-মায়ের অবর্তমানে এই সন্তানদের কে দেখবে তা আমরা কেউ জানি না। হয়তো সব অটিজম বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন সন্তানের জন্য আমরা কিছু করতে পারব না, তবে কমিউনিটিকে সচেতন হতে হবে। কমিউনিটিকে পাশে দাঁড়াতে হবে। কেননা এই সন্তানেরা যত দিন বেঁচে থাকবেন তাঁদের কোনো না কোনো কাজে অন্যের সহায়তা লাগবেই।’

শুরুতে শুধু অভিভাবকেরা এগিয়ে এলেও আস্তে আস্তে প্রতিষ্ঠানটির সহায়তায় এগিয়ে এসেছেন অনেক ব্যক্তি ও বড় কয়েকটি প্রতিষ্ঠান। কেরানীগঞ্জের ২৩ কাঠা জমিতে গড়ে উঠে বর্তমানে ফাউন্ডেশন ভবনটি। বর্তমানের এই ২৩ কাঠা জমি ফাউন্ডেশনের জন্য দান করেছেন রানার গ্রুপের চেয়ারম্যান জনাব হাফিজুর রহমান খান। প্রশিক্ষণ সরঞ্জাম কেনা, ক্লাস রুম তৈরিসহ বিভিন্ন কাজে এবি ব্যাংক লিমিটেড, বিএসআরএম কনফিডেন্স গ্রুপ, এমজিএইচ গ্রুপসহ অনেক নাম যুক্ত হচ্ছে। অটিজম আক্রান্ত শিশুদের জন্য অত্যাবশ্যকীয় সুইমিং পুলের কাঠামো তৈরি করা আছে, তা শেষ করতে ৩০ লাখের বেশি টাকা লাগবে।

অটিজম ওয়েলফেয়ার ফাউন্ডেশনের চেয়ারপার্সন, অধ্যাপক ডাঃ শারমিন ইয়াসমিন, যিনি বর্তমানে বিভাগীয় প্রধান, পাবলিক হেল্থ ডিপার্টমেন্ট, বাংলাদেশ মেডিকেল কলেজ, এবং চেয়ারপার্সন, পাবলিক হেল্থ ফাউন্ডেশন, বাংলাদেশ, বিভাগীয় প্রধান, পাবলিক হেল্থ ডিপার্টমেন্ট, বাংলাদেশ মেডিকেল কলেজ। সম্প্রতি তার সাথে একান্ত আলাপকালে তিনি বলেন, অটিজম ওয়েলফেয়ার ফাউন্ডেশন, আমার সন্তানের মত, এই ফাউন্ডেশনকে নিয়ে প্রতিনিয়িত বিভিন্ন স্বপ্ন বুনতে থাকি। তিনি বলেন, অটিজম শিশুদের ব্যায়ামের জন্য সুইমিং পুল তৈরিসহ কিছু স্বপ্ন এখনো দেখছি। এর জন্য প্রয়োজন আর্থিক অনুদান ও আন্তরিক সহযোগিতা। বিত্তবান ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের সহযোগিতায় সুইমিং পুল তৈরীতে অবদান রাখতে পারেন যে কেউ।

অটিজম ওয়েলফেয়ার ফাউন্ডেশনের ভাইস চেয়ারপার্সন, স্থপতি আনিকা তাবাস্সুম বলেন, অটিজম শিশুদের মানষিক বিকাশের জন্য সুইমিং পুল অত্যন্ত জরুরী। তিনি বলেন, আমাদের স্থায়ী ক্যাম্পাস, বসিলা, কেরানীগঞ্জ-এর গ্রাউন্ড ফ্লোরে একটি সুইমিং পুল নির্মাণের কাজ চলমান রয়েছে, যা আমাদের বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন শিক্ষার্থীদের শারীরিক ও সংবেদনশীল বিকাশে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। এই প্রকল্পটি সফলভাবে সম্পন্ন করতে একটি উল্লেখযোগ্য পরিমাণ অর্থ প্রয়োজন, যা শুধুমাত্র ফাউন্ডেশনের নিজস্ব সামর্থ্যে সম্ভব নয়। এজন্য বিত্তবানদের আন্তরিক সহযোগিতা ও উদার অংশগ্রহণ একান্তভাবে কাম্য। যে কেউ চাইলে ব্যক্তিগতভাবে অনুদান প্রদান করতে পারেন অথবা সম্ভাব্য স্পনসর বা সহায়তাকারীদেরও অনুপ্রাণিত করতে পারেন।

আমরা সেপ্টেম্বর ২০২৫-এর মধ্যে নির্মাণকাজ শুরু করতে আগ্রহী। অনুদান প্রদান বা বিস্তারিত তথ্যের জন্য নিচের যে কোনও কর্মকর্তার সঙ্গে যোগাযোগ করার অনুরোধ জানানো যাচ্ছে: অনুদান প্রদান বা বিস্তারিত তথ্যের জন্য নিচের যে কোনও কর্মকর্তার সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারেন।

অ্যাডমিন অফিসার: +৮৮০১৬৭৬-৩৬৯৭০৪, অ্যাকাউন্টস অফিসার: +৮৮০১৭১৫-৪০৭২৫৩, এইচ.আর. এক্সিকিউটিভ: +৮৮০১৭১৭-১৭১৫৭৭, প্রোগ্রাম কো-অর্ডিনেটর: +৮৮০১৬৭৩-২৯৬৬৩৭।#

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

- Advertisment -

সর্বাধিক জনপ্রিয়

সাম্প্রতিক মন্তব্য